জাহাজজটের যন্ত্রণার বছর

চট্টগ্রাম বন্দরের সাম্প্রতিক চিত্র l ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম বন্দরের সাম্প্রতিক চিত্র l ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাহাজ কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের সহযোগী সংস্থা এমসিসি ট্রান্সপোর্ট এ বছর চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার জাহাজের জট নিয়ে ২৬ বার গ্রাহকদের নোটিশ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিটি নোটিশের মূল ভাষ্য ছিল, জটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর ক্ষেত্রে তারা দীর্ঘ অপেক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হয় তা বলা কঠিন। ১৯ ডিসেম্বর ২৬তম নোটিশেও ছিল এই ভাষ্য।

এ তো গেল কনটেইনার জাহাজের এ বছরের চিত্র। সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজের জট ছিল আরও ভয়াবহ। সাধারণ পণ্যবাহী ছোট আকারের জাহাজ বন্দরের জেটিতে এবং বড় জাহাজ থেকে বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করা হয়। কয়েকটি অগ্রাধিকার পণ্যবাহী জাহাজ ছাড়া এ ধরনের জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর জন্য কমবেশি ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর লাইটার জাহাজ না পেয়ে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে ১৫ থেকে ১৮ দিনের পরিবর্তে ৪০ থেকে ৪৫ দিন সময় লেগেছে।

বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কনটেইনার জাহাজের দীর্ঘমেয়াদি জট বিশ্বের কোথাও নেই। এই জটের মূল কারণ গত ১০ বছরে বন্দরের মূল অবকাঠামোয় একটিও জেটি যোগ না হওয়া। অথচ এ সময়ে পণ্য পরিবহন বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ফলে যন্ত্রপাতি বা অন্য অবকাঠামো যতই থাকুক, জাহাজ থেকে কনটেইনার বা পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য জেটি না থাকায় জটও দূর হচ্ছে না। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বহু আগে থেকেই সরব ছিলেন। দেশের প্রতিটি শিল্প খাতের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে এ বছর থেকে উচ্চারিত হচ্ছে বন্দর-সুবিধার অভাবের কথাও।

বন্দরের এ অবস্থা এক দিনে হয়নি। তিন-চার বছর আগে থেকে শুধু বাজেট ও রোজার আগে পণ্য পরিবহনের চাপে জাহাজের জট থাকত। ২০১৬ সালে এসে প্রথমবারের মতো এপ্রিল-মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বছরের দুই-তৃতীয়াংশ সময়জুড়ে ছিল জাহাজজট। এ বছর প্রথম দিন শুরু হয়েছে জট দিয়ে। শেষও তা-ই। বছরজুড়ে গড়ে প্রতিদিন জেটিতে ভেড়ানোর জন্য প্রায় ১২টি জাহাজ বহির্নোঙরে দাঁড়িয়ে থাকত। এই অপেক্ষার সময় ছিল সর্বনিম্ন ১ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত।

শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন যে বাড়বে, সেটি এ পর্যন্ত বন্দরের প্রণয়ন করা সব সমীক্ষায় বলা হয়েছিল। এ জন্য দরকার ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিসহ অবকাঠামো বাড়ানো ও নতুন বন্দর গড়ে তোলা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বন্দরের নীতিনির্ধারকেরা নতুন বন্দর হিসেবে পায়রা সমুদ্রবন্দরকে বেছে নিয়েছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০১৮ সালে পায়রায় জেটি নির্মাণ হবে। কিন্তু নতুন জায়গায় প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে এ দেশে যে এত দ্রুত অবকাঠামো তৈরি সম্ভব নয়, সেটি বুঝতে পারেননি নীতিনির্ধারকেরা। ফলাফল, পায়রা চালু হয়নি, চট্টগ্রাম বন্দরে বেড়েছে জট।

আমদানি ও রপ্তানিতে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বন্দরসেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্দরসেবায় কোনো ঘাটতি হলে দেশের সাধারণ মানুষকেও তার মূল্য দিতে হয়। এখনো বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনের ৮৯ শতাংশ জাহাজে পরিবহন হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বন্দর দিয়ে ব্যবসার খরচ বাড়লে তা সাধারণ মানুষকেই পরিশোধ করতে হয়। কারণ ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্যের সঙ্গে এই খরচ যোগ করে ক্রেতাদের কাছ থেকেই আদায় করেন।