সুশাসনের সূচকে সুখবর নেই

বিদায়ী বছরে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থসামাজিক খাতে বড় কোনো সুখবর নেই। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করা আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে গেছে। আবার টাকা পাচারও থেমে থাকেনি। মানব উন্নয়নে কয়েক বছর ধরেই উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিদায়ী বছরে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনগুলো ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ব্যবসায় সহজ করার সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়ে গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, এক বছরেই প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার

হয়ে গেছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে মাত্র এক ধাপ এগিয়েছে। দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৫তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার এসব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। তারপরও সরকার হিসাবে পরপর দুই অর্থবছর ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার সূচকগুলোর উন্নতি হচ্ছে না, বরং অবনতিই হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামসহ (ডব্লিউইএফ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়নে বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ছে। যেমন টাকা পাচার হচ্ছে, আবার বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে না। তিনি আরও বলেন, এত প্রতিকূলতার পরও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন সাফল্য। যদিও সরকার বলছে, ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা প্রশ্নবিদ্ধ। আমার মতে, সেটা ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এটাও ভালো প্রবৃদ্ধি।

ব্যবসা করা আরও কঠিন
বাংলাদেশে ব্যবসা করা আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট ২০১৮ বা সহজে ব্যবসা করার সূচক অনুযায়ী, এ বছর ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। এক বছরের ব্যবধানে এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। তবে ব্যবসা করার পরিবেশ বাংলাদেশের নম্বর বা স্কোর আগের বছরের চেয়ে সামান্য বেড়েছে। যদিও অন্য দেশের স্কোর বেড়েছে আরও বেশি। এর মানে হলো, অন্য দেশগুলো ব্যবসায় পরিস্থিতিতে যেভাবে উন্নতি করেছে, বাংলাদেশ সেভাবে পারেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ১৮৩তম স্থানে থাকা আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় অষ্টম। এই অঞ্চলে শীর্ষস্থানে থাকা ভুটানের অবস্থান ৭৫তম। অন্যদিকে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত ১০০তম স্থানে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা ১১১তম, নেপাল ১০৫তম, মালদ্বীপ ১৩৬ ও পাকিস্তান ১৪৭তম।

এই প্রতিবেদন তৈরি করতে দশটি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো ব্যবসায় শুরু, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি, বিদ্যুৎ প্রাপ্যতা, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণের প্রাপ্যতা, ছোট বিনিয়োগের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তির বাস্তবায়ন ও অসচ্ছলতা দূরীকরণ। এই ১০টি সূচকের মধ্যে পাঁচটিতেই অবস্থানের অবনতি হয়েছে। এ বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১৯০টি দেশের অবস্থান ১৮৯তম।

বেড়েছে সক্ষমতা
বিশ্ববাজারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আরও বেশি ভালো অবস্থানে গেছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে সাত ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক বা গ্লোবাল কম্পিটিটিভ ইনডেক্সে (জিসিআই) ২০১৭-১৮ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে ৯৯তম অবস্থান পেয়েছে। আগেরবার বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৬তম।
ডব্লিউইএফ বলছে, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ১৬টি সমস্যা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। অন্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামো দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ত সুযোগ, উচ্চ করের হার।

কিন্তু এতে খুব বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। এই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার যে ছয়টি দেশ স্থান পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অন্য দেশগুলো তুলনামূলক বেশি ধাপ এগিয়েছে। সবচেয়ে ভালো করেছে ভারত। ভারতের অবস্থান ৪০তম। এরপরই ৮২তম স্থানে আছে ভুটান। ভুটান এক বছরে ১৫ ধাপ এগিয়েছে। এ ছাড়া নেপাল ৮৮তম, শ্রীলঙ্কা ৮৫তম স্থানে আছে। বাংলাদেশের পেছনে থাকা পাকিস্তান ১১৫তম স্থানে আছে।
বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ৫৫তম ও কম্বোডিয়া ৯৪তম স্থানে আছে। বরাবরের মতো এবার এই সূচকে শীর্ষস্থানে আছে সুইজারল্যান্ড।

টাকা পাচার চলছেই
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার চলছেই। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। গত মে মাসে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) টাকা পাচারের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে সর্বশেষ ২০১৪ সালের তথ্য রয়েছে। গত ১০ বছরে পাচার বরা টাকা দিয়ে অন্তত ২০টি পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত। আমদানি-রপ্তানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) চেয়ে বেশি। ওই অর্থবছরে এডিপির মাধ্যমে ৭১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল।
অন্যবারের মতো এবার টাকা পাচারের হিসাবে দেশগুলোর পৃথক ক্রমতালিকা করেনি জিএফআই। আগের দুটি প্রতিবেদনে দেড় শর মতো দেশ তালিকায় ছিল। প্রতিবারই বাংলাদেশ প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায় ছিল।

মানব উন্নয়নে সামান্য অগ্রগতি
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়সহ সামাজিক বিভিন্ন সূচকে অনেক উন্নতি করেছে। প্রতিবছর এই উন্নতির চিত্র চোখে পড়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকে। গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ২০১৬ সালের মানব উন্নয়ন সূচকে এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯তম। ২০১৫ সালের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ১৪০তম স্থানেই অবস্থান ছিল আগের দুই বছর। তিন বছর আগে ছিল ১৪২তম স্থানে। এর মানে হলো, গত কয়েক বছরে খুব বেশি অগ্রগতি হচ্ছে না।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে আফগানিস্তান, নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়ে ওপরে আছে বাংলাদেশ। পেছনে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপের।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ১৩ দশমিক ৬ বছর বেড়েছে। এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭২ বছর। গত ২৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জাতীয় আয় প্রায় ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশে এখন মধ্যম মানের মানব উন্নয়ন হচ্ছে বলে মনে করে ইউএনডিপি।

দুর্নীতি আছে
বাংলাদেশে এখনো দুর্নীতি আছে। তবে শীর্ষ দেশের অবস্থান থেকে বের হয়ে এসেছে। ক্রমশ ভালো করছে বাংলাদেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করা দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) বাংলাদেশের ১ পয়েন্ট বেড়ে ২৬ হয়েছে। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এবার অবস্থান ১৫তম। গতবারের সূচকে অবস্থান ছিল ১৩তম।

আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সব দেশের তুলনায় খারাপ অবস্থানে বাংলাদেশ। সবাই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি স্কোর করেছে। টিআইবির সিপিআই অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে ছিল বাংলাদেশ।