ইসলামী ব্যাংক কোনো উপাসনালয় নয়

>

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) বিনিয়োগের হিসাবে দেশের শীর্ষ ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে কার্যক্রমে আসা ব্যাংকটির পদচারণ রয়েছে আর্থিক খাতের সব ক্ষেত্রে। পরিচালনায় ঈর্ষণীয় সাফল্যও দেখিয়েছে। কার্যক্রম শুরুর ৩৩ বছর পর ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তাতে ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক সচিব আরাস্তু খান। পরিবর্তনের এক বছর পর ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

আরাস্তু খান
আরাস্তু খান

প্রথম আলো: ৩৩ বছর পর ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো কেন?

আরাস্তু খান: ব্যাংকটিতে একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বড় আলোচনা ছিল। এ নিয়ে সবার মধ্যেই উদ্বেগ ছিল। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অনেক শেয়ার কিনে ফেলে। তাতেই এ পরিবর্তন আসে। অনেকে ব্যাংকটি বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন, এটা হলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যেত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিমালার আলোকে ব্যাংকটি পরিচালনার জন্য বিশেষ দিকনির্দেশনা দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা পুরো দেশের জন্য আশীর্বাদ। ব্যাংকটি এখন আগের চেয়ে আরও বেশি পেশাদারির সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।

প্রথম আলো: আপনারা দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশি শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ উদ্বেগ দেখিয়েছে। অনেকে তো শেয়ার ছেড়েও দিয়েছে। এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আরাস্তু খান: ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), সৌদি আরব, কুয়েত, জর্ডানসহ বাংলাদেশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মিলে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে শেয়ার সব সময় বিদেশিদের বেশি ছিল, কিন্তু বাংলাদেশিরা ব্যাংকটি চালিয়েছে। আইডিবি কিছু শেয়ার ছেড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি মুসলিমপ্রধান দেশে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। এখানে ইসলামী ব্যাংক সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই এখন তারা কিছু শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে। তবে একজন পরিচালক থাকার জন্য যা শেয়ার প্রয়োজন, তা তাদের রয়েছে। আইডিবি ট্রিপল এ মানের ব্যাংক, তারা ব্যাংকের বোর্ডে থাকলে আমাদের জন্য ভালো হয়, জনগণেরও আস্থা বাড়ে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকে আল-রাজি গ্রুপের প্রায় ২৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কুয়েতের একটি প্রতিষ্ঠান কিছু শেয়ার ছেড়ে দেবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় শেয়ার বাড়বে। ফলে মুনাফার টাকা দেশেই থাকবে। কুয়েতের আরেকটি প্রতিষ্ঠান পরিচালক হিসেবে আসতে ইচ্ছা পোষণ করছে, আমরা বিষয়টি বিবেচনা করছি।

প্রথম আলো: ইসলামী ব্যাংককে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করা হয়। এতে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?

আরাস্তু খান: ১৯৮৩ সালে যখন ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক ছিল না। তারা পরে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জামায়াতের সমর্থনে কিছু লোক এ ব্যাংকে রয়েছে, অন্য প্রতিষ্ঠানেও আছে। জামায়াতের লোকজন একসময় ৫ শতাংশ শেয়ার নিয়েই ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করত। আর কোনো বড় প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে ছিল না। পরে বেশ কটি প্রতিষ্ঠান ১৭ শতাংশের মতো শেয়ার কিনে নেওয়ায় বোর্ডে তাদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে।

প্রথম আলো: ব্যাংকে পরিবর্তনের এক বছর হলো। কী পরিবর্তন এল?

আরাস্তু খান: দায়িত্ব নিয়ে আমরা প্রথমেই বলেছিলাম, ইসলামী ব্যাংক শরিয়া ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, এর কোনো নড়চড় হবে না। আমরা তা পুরোপুরি পালনের চেষ্টা করেছি। ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে আরও কয়েকটি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। সেই ব্যাংকগুলোর তুলনায় ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান অনেক এগিয়ে ও সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত। শুধু সেবার মানেই এ অবস্থান তৈরি হয়নি, বরং শরিয়া নীতি পরিপালনই এ ব্যাংকের মূল শক্তি। যার ফলে দেশের জনগণ এ ব্যাংকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সুদ নিতে হবে না, এ কারণে ধর্মপ্রাণ মানুষ এ ব্যাংকের প্রতি আস্থা রেখেছে। ফলে ইসলামী ব্যাংক আজ দেশের শীর্ষ ব্যাংক। শুধু শরিয়া নীতি পরিপালনের জন্যই এ ব্যাংকে আজ ৭৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা আমানত জমা রয়েছে। শরিয়া নীতি থেকে বিচ্যুত হলে সব হারিয়ে যাবে।

প্রথম আলো: এক বছরে ব্যাংক পরিচালনায় কী কী পরিবর্তন এসেছে?

আরাস্তু খান: ব্যাংকের ১৩ হাজার ৫০০ কর্মকর্তার মধ্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। আমরা এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছি, নতুন নিয়োগে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, পদোন্নতিতে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক কোনো উপাসনালয় নয়, তাই এ ব্যাংকে চাকরির দরজা সব ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। অন্য ধর্মের লোকেরা আমানত রাখা ও বিনিয়োগ নিতে পারলে, তাদের চাকরি দেব না কেন? পাশাপাশি নিয়োগের যে সিলেবাস আছে, তাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রশ্নকাঠামো সর্বজনীন করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের কর্মীদের সততা ও নিষ্ঠা অনেক বেশি। এ জন্যই এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি।

প্রথম আলো: অনেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। তার বিপরীতে বিনিয়োগ অনেক বেড়ে গেছে। এক বছরে আর্থিক অবস্থা কী দাঁড়াল?

আরাস্তু খান: আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর আমানত কিছুটা কমতে শুরু করেছিল, তা সামলে নিয়ে আরও সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত বেড়েছে। আমরা এক বছরে ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ দিয়েছি। আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ শতাংশ। বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। পুরো দেশে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ, আমরা তার চেয়ে অনেক কম বিনিয়োগ দিয়েছি। বিনিয়োগ নীতিমালায় আগের পর্ষদের সঙ্গে আমাদের কোনো ভিন্নমত নেই, রাজনৈতিক দ্বিমত ছাড়া। খেলাপি বিনিয়োগ আমরা সাড়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। তেলের দাম কমে যাওয়ায় প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। ইসলামী ব্যাংক বাজারের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করছে। তবে গত বছর আমাদের রেমিট্যান্স ৪ শতাংশ কমেছে। তবে প্রবাসীদের স্বার্থে আমরা নিজেদের কমিশন কমিয়েছি। তাই গত কয়েক মাসে আমাদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা আবার বেড়েছে।

প্রথম আলো: অভিযোগ ছিল, ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সন্ত্রাসে অর্থায়ন হয়। এমন অর্থায়ন কি বন্ধ করা গেছে?

আরাস্তু খান: একসময় অভিযোগ ছিল, ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরপরই ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। সাত বছর তদন্ত করলেও কোনো প্রমাণ মেলেনি। আগে ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন আমরাই জোগান দিতাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সাল থেকে এটা বন্ধ করে রেখেছে। এ কারণে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান কিছুটা কমেছে। তবে তারা নিজেরাই চলতে পারছে। আমরা শিগগিরই তাদের মূলধন জোগান দিতে পারব। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

প্রথম আলো: দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। ডলারের ওপরও তো চাপ তৈরি হয়েছে।

আরাস্তু খান: বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যদিও কয়েক বছর ধরে ১৫ শতাংশের বেশি ছিল না। বন্যার কারণে চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়েছে। বিদেশি ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায়, তা পরিশোধ করতে হচ্ছে। মূলধনি যন্ত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে। এ অবস্থায় আগামী বছরের বড় চ্যালেঞ্জ হবে তারল্য ব্যবস্থাপনা। নির্বাচনের বছর হওয়াতে উন্নয়ন খরচ বাড়বে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে মুদ্রানীতি কী হবে? ঋণের সীমা কমানোর চিন্তা চলছে বলে শুনেছি, নির্বাচনী বছরে এমন সিদ্ধান্ত কী প্রভাব ফেলবে, তা ভেবে দেখা দরকার।

ব্যাংকগুলোর কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ভালো অবস্থায় ছিল, কিন্তু দুই বছর ধরে তা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের পরও ডলারের ওপর চাপ বাড়ছেই। এসবই সামনের দিনে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ তৈরি করবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ একটা বড় সমস্যা। তবে খেলাপি ঋণ সরকারি ব্যাংকেই বেশি, এ জন্য বড় সমস্যা মনে করছি না।