নির্বাচনের বছরে শেয়ারবাজার চরম আস্থাহীন

>
  • শেয়ারবাজারে সূচকের বড় পতন।
  • আশা ছিল নির্বাচনের বছরে বাজার ভালো যাবে।
  • বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা।
  • চলতি মার্চেই সূচক কমেছে ৩৭৯ পয়েন্ট।

দেশের শেয়ারবাজারে আবারও চরম আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই কমছে সূচক ও শেয়ারের দাম। নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নির্বাচন সামনে রেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল বছরটিতে শেয়ারবাজার ভালো যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো।

অব্যাহত দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীর মধ্যে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের বাজারধসের আতঙ্ক আবারও ভর করছে। শেয়ারবাজারের এ দুটি বড় কেলেঙ্কারির ঘটনাই ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে। 

দেশের শেয়ারবাজারে গতকাল মঙ্গলবারের দরপতন ছিল শতাংশের হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়। গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৮ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৪১ শতাংশ কমে সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নেমে এসেছে। দিন শেষে সূচকটি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৯২ পয়েন্টে। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক গতকাল ২৩০ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে।

বাছবিচার ছাড়াই সব ধরনের শেয়ারের দরপতনে সূচক একের পর এক মনস্তাত্ত্বিক সীমা ভেঙে নিচে নামছে। প্রথম দফায় ডিএসইর সূচক ৬ হাজারের মাইলফলকের নিচে নামার পর অনেক বিনিয়োগকারী ভেবেছিলেন সূচক হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু উল্টো তা সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নেমে এসেছে। গত জুনের বাজেট-পরবর্তী সময়ে ডিএসইতে সূচক যতটা বেড়েছিল, গত প্রায় দুই মাসের পতনে তা আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে। গতকালের ডিএসইএক্স সূচক ছিল গত ১৯ জুনের অবস্থানে। 

গতকাল ঢাকার বাজারে লেনদেন হওয়া ৩৩৩ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা ২৮২টিরই দাম কমেছে, বেড়েছে মাত্র ১১ শতাংশ বা ৩৭টির দাম। আর অপরিবর্তিত ছিল ১৪টির দাম। ভালো লভ্যাংশ ও আয় বৃদ্ধির ঘোষণার পরও দাম কমছে শেয়ারের। চট্টগ্রামের বাজারে লেনদেন হওয়া ৮৪ শতাংশ শেয়ারেরই দাম কমেছে। 

বাজারে এ দরপতনের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে আবারও চরম আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক এ দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কারসাজির হাতিয়ার হিসেবে কিছু অযৌক্তিক কারণকে সামনে আনা হয়েছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ, যিনি একসময় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকেই বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতনের জন্য তারল্যসংকটকে দায়ী করছেন। তবে তারল্যসংকট বড় কারণ বলে আমি মনে করি না। কারণ, গত জানুয়ারিতেও ব্যাংক খাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। তার মানে বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো বেশি ঋণ যাচ্ছে। তাই তারল্যসংকট বাস্তব কারণ নয়, বরং এটিকে বড় কারণ বানানো হচ্ছে বলেই আমার ধারণা। এ ছাড়া ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে টানাপোড়েনের ঘটনাটি বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যদিও সাধারণ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারীর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।’ 

গত কয়েক দিনে বাজারের একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ একেবারেই কমে গেছে। অনেক ব্যাংক তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়ে অন্যত্র খাটাচ্ছে। ব্যাংক খাতে হঠাৎ করে আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় অনেকে শেয়ারবাজারের পরিবর্তে ব্যাংকে টাকা লগ্নি করছেন।

শেয়ারবাজারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক দরপতনে সবচেয়ে বেশি কমছে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের শেয়ারের দাম। গতকালও ব্যাংক খাতের লেনদেন হওয়া প্রতিটি শেয়ারের দাম গড়ে ২ শতাংশ এবং আর্থিক খাতের প্রতিটি শেয়ারের দাম গড়ে সোয়া ২ শতাংশের মতো কমেছে। সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতেই এসব কোম্পানির শেয়ার বেশি থাকে। 

এদিকে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুকে কেন্দ্র করে মতিঝিলের শেয়ারবাজারে পাড়ায় বেশ কিছু দিন ধরে নানা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। চীন ও ভারতের আলাদা দুটি জোট ডিএসইর শেয়ার কিনতে আগ্রহী। চীনের জোটের কাছে শেয়ার বিক্রি করতে এককাট্টা ডিএসইর সদস্যরা। বাজারে গুঞ্জন রয়েছে, যদি চীনের প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দেওয়া না হয়, তবে বাজারে তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চীনের প্রস্তাবের আইনি দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রস্তাবটি সংশোধন করে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি। 

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বাজারে পতন শুরু হয়। তাতে গত তিন মাসে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে প্রায় ৭৬২ পয়েন্ট। এর মধ্যে ১ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র ১৭ কার্যদিবসে কমেছে প্রায় ৩৭৯ পয়েন্ট। 

চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর ঘোষণার পর থেকেই মূলত শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়। চাপে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়ালেও শেয়ারবাজারের পতন থামেনি। 

বাজারের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্রমাগত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাজারে কিছুটা তারল্যসংকটও বিরাজ করছে। তারল্যসংকট কাটিয়ে বাজারে আস্থা ফেরাতে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো এরই মধ্যে সরকারের বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। 

বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতনের পেছনে কোনো কারসাজি রয়েছে কি না, জানতে চাইলে সাইফুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কারসাজির কোনো নমুনা আমাদের চোখে পড়েনি। কোনো প্রতিষ্ঠান ইচ্ছেকৃতভাবে দরপতন ঘটাতে আগ্রাসীভাবে শেয়ার বিক্রি করছে কি না, সে বিষয়টিও আমরা নজরে রেখেছি।’

তবে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি দুর্বলতার কারণেই বাজারে নানাভাবে কারসাজির ঘটনা ঘটে। দেখা যায়, যেদিন বাজারে বিএসইসির তদারকি শক্তিশালী থাকে, সেদিন খুব বেশি সূচক কমে না। একাধিক বিনিয়োগকারী বলেছেন, বাজারে যদি সংকটই থাকবে তাহলে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটে কীভাবে? আসলে একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাজারকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। আর তাতে বারবার নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।