বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি তদন্তের শেষ কবে

শেখ আবদুল হাই বাচ্চু
শেখ আবদুল হাই বাচ্চু
>
  • দুদকের তদন্ত চলছে।
  • তদন্তের জন্য আদালতের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ।
  • তদন্ত শেষ করতে পারেনি দুদক।

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ কীভাবে জড়িত, আদালতই তা দেখিয়ে দিয়েছেন।

তবে এই কেলেঙ্কারির বিষয়ে তদন্ত এখনো শেষ করতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি এ বিষয়ে আদালতের দেওয়া সময়সীমা পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে।

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে সৈয়দ ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করে। ব্যাংকের ঋণ (ক্রেডিট) কমিটি সৈয়দ ট্রেডার্সকে ঋণ দেওয়ার সুপারিশ করেনি, তারপরও পরিচালনা পর্ষদ তড়িঘড়ি করে ওই গ্রাহকের পক্ষে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত বছরের ২৬ জুলাই এক রায়ে বলেছেন, ‘আমাদের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে যে ঋণ কমিটির সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডিসহ পুরো পরিচালনা পর্ষদ কীভাবে শুরুতে ১৭ কোটি টাকা, পরে আরও ৪০ কোটি টাকা ঋণ সৈয়দ ট্রেডার্সকে দিয়ে দিল!’

দুদক ২০১৫ সালে সৈয়দ ট্রেডার্সের জরিপকারী রূপসা সার্ভেয়ারসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদক শাহজাহান আলীকে গ্রেপ্তার করে ২০১৬ সালের আগস্টে এবং সেপ্টেম্বরে তিনি জামিন পান।

বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি শহীদুল করিমের যৌথ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ১২ জুলাই মামলার শুনানি নিয়ে দুই সপ্তাহ পর ২৬ জুলাই আট পৃষ্ঠার রায় দেন। ওই রায়ে পর্ষদ সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দুদককে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করতে বলেন আদালত।

শেখ আবদুল হাইয়ের সময়ে (২০০৯-১৪) বেসিক ব্যাংক থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বেরিয়ে গেছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুদক অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করলেও গোটা পর্ষদকে আড়ালে রাখে।

আদালত ক্ষুব্ধ, নতুন মোড়
মামলা হওয়ার দুই বছর পার হলেও কোনো অভিযোগপত্র তৈরি না হওয়ায় শাহজাহান আলীর মামলার শুনানির সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আদালত। এ রায়ের পরই ঘটনাটি নতুন মোড় নেয়। দুদক তখনই প্রথমবারের মতো পর্ষদ সদস্যদের নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

রায় বিশ্লেষণে দেখা যায়, আদালত বিস্ময়ের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে দায় থাকলেও শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে মামলাটিতে পর্ষদ সদস্যদের নাম নেই।

সৈয়দ ট্রেডার্সের যে ঋণ প্রস্তাবের বন্ধকি সম্পত্তির জরিপকারী রূপসা ট্রেডার্স, সৈয়দ ট্রেডার্সের ভুয়া ঋণ প্রস্তাব, ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে অতিমূল্যায়িত বন্ধকি সম্পত্তি, প্রস্তাবের বিপক্ষে ব্যাংকের ঋণ কমিটির মত না থাকার পরও পরিচালনা পর্ষদের ঋণ অনুমোদন এবং পরে আরও ঋণ দেওয়া—এসব বিষয় উঠে আসে আদালতের রায়ে।

পাঁচ দিনের মাথায় ঋণ
সৈয়দ ট্রেডার্স ২০১০ সালের ২৮ অক্টোবর বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় একটি হিসাব খোলে এবং সৈয়দ ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা অংশীদার সৈয়দ মাহবুবুল গণি মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ২ নভেম্বর শাখার কাছে ১৭ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। বিপরীতে বন্ধকি হিসেবে এমন কিছু সম্পদ রাখেন, যেগুলো অন্য ব্যাংকে বন্ধক ছিল।

প্রতিষ্ঠানটির ঋণ আবেদনের দিনই ছিল ব্যাংকের পর্ষদ বৈঠক। রায়ে বলা হয়, ঋণ কমিটির নেতিবাচক মন্তব্য থাকার পরও পর্ষদ সৈয়দ ট্রেডার্সের ১৭ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং এক বছর পর ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে করে৩০ কোটি টাকা। পর্ষদ ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর ঋণের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা দেয়। মামলার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাঁচ কোটি টাকার মতো ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কিছু দায় পরিশোধ করে গ্রাহক।

তদন্ত কবে শেষ হবে
আদালতের রায়ে বলা হয়, রায় পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। আদালতের দেওয়া সময়সীমা মানতে ব্যর্থ হয়েছে দুদক। এক মাসে ২২ কার্যদিবস ধরে হিসাব করলে ৬০ কার্যদিবস শেষ হয় গত বছরের অক্টোবরে। এমনকি দ্বিগুণ কার্যদিবসও পার হয়ে গেছে গত জানুয়ারিতে, কিন্তু দুদক এর মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারেনি।

তবে দুদক এখন পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ওই সময়ের পর্ষদের সদস্যদের কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাঁদের বর্তমান কার্যালয়ে গিয়ে।

এর মধ্যে শেখ আবদুল হাইকে চারবার দুদকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দুদকের দল সচিবালয়ের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পায়নি, দুদক কার্যালয়েও ডেকে আনতে পারেনি তাঁকে। তিনি বাণিজ্যসচিব শুভাশীষ বসু। শুনানি না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি গত রাতে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘কীসের শুনানি? আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কাছে কখনো জানতে চাইবেন না।’

তবে দুদক সূত্রে জানা গেছে, আরেক দফা নোটিশ পাঠানোর পরও শুভাশীষ বসু যদি শুনানি না দেন, দুদক পরে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবে।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গতকাল বুধবার বলেন, ‘যতটুকু জানি, শিগগিরই বেসিক ব্যাংকের তদন্তকাজ শেষ হবে।’