টাকা আদায় করতে না পেরে শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকের কাছে জিম্মি সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক

রাজনৈতিক বিবেচনায় ও নিয়ম ভঙ্গ করে দেওয়া ঋণ ক্রমেই খেলাপি হয়ে পড়ছে। এসব ঋণের শীর্ষ গ্রাহক থেকে ব্যাংকগুলো টাকা আদায় করতে পারছে না, আইনি ব্যবস্থাতেও কিছু হচ্ছে না। এর মধ্যে বড় অংশই বর্তমান সরকারের মেয়াদে দেওয়া ঋণ।

টাকা আদায় করতে না পেরে এসব শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক। এসব শীর্ষ খেলাপির কেউ কেউ পুরোনো গ্রাহক, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা বন্ধ। আরেকটি অংশে আছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তাঁরা নানা ধরনের ঋণসুবিধা নিয়েও এখন আর ফেরত দিচ্ছেন না। এতে লোকসানে পড়ছে এসব ব্যাংক। আর এই লোকসানের বোঝা সামলাতে প্রতিবছরই বাজেট থেকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। আর তা দেওয়া হচ্ছে জনগণের করের টাকা থেকে। সরকারি ব্যাংকগুলোকে গত নয় বছরে জনগণের করের টাকা থেকে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে আরও অর্থ দেওয়া হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।

২০১৭ সাল শেষে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই চার ব্যাংকের আটকা ১১ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে।

সোনালীর শীর্ষ খেলাপি বেক্সিমকো
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছেই আটকা ৪ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। খেলাপি গ্রাহকদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। গ্রুপটির ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ পুনর্গঠন-সুবিধা নিয়েও নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ না করায় আবারও খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে বেক্সিমকো। ব্যাংকটির হল-মার্ক গ্রুপ ছাড়া অন্য খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বেশ আগের।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক-দুই বছরের মধ্যে বড় গ্রাহকদের কেউ খেলাপি হয়নি, সবগুলোই আগের। যোগাযোগ করে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে না হলে আইনি প্রক্রিয়ায় টাকা আদায়ের উদ্যোগ চলছে। তবে এ প্রক্রিয়াটা বেশ ধীরগতির।’

সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো বেক্সিমকো, টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, হল-মার্ক, ফেয়ার ট্রেড, রহমান গ্রুপ, মুন্নু ফেব্রিকস, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, লীনা পেপার, মাগুরা পেপার, জিএমজি এয়ারলাইন, মেঘনা কনডেন্সড, এপেক্স উইভিং, সোনালী জুট, ডেলটা জুট, একে জুট, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ, এফআর জুট, বিশ্বাস গার্মেন্টস, মেঘনা ভেজিটেবল ও রেজা জুট ট্রেডিং। 


অগ্রণীর খেলাপি দেশছাড়া
অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছে পাওনা ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের তফাত হলো, খেলাপি গ্রাহকদের বড় অংশই ঋণ পেয়েছে ২০১০ সালের পরে। এসব গ্রাহকের অনেকেই ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ না করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এর মধ্যে শীর্ষ খেলাপি চট্টগ্রামভিত্তিক ম্যাক শিপবিল্ডার্স ও ম্যাক শিপব্রেকিংয়ের কাছে পাওনা যথাক্রমে ১৫৯ কোটি ও ৫২ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস উল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি গ্রাহকদের থেকে টাকা আদায়ে কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে যাতে কেউ খেলাপি না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। বেশ কিছু টাকা আদায়ও হয়েছে।’

ব্যাংকটির শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকেরা হলো এরিস্টোক্র্যাট এগ্রো ও নন ওভেন, আর্থ এগ্রো, এমআর সোয়েটার, জুলিয়া সোয়েটার, ফেরদৌস জুট মিলস, ঢাকা ডেনিম, জিল টেক্সটাইল, ইফতি ফ্যাশন, জয় কম্পোজিট, মাধবদী ট্রেডিং, গিভেন্সি স্পিনিং, সুরুজ মিয়া জুট, কেয়া ইয়ার্ন, সাদাত টেক্সটাইল, ম্যাক শিপবিল্ডার্স, আরাফাত স্টিল, সিদ্দিক ট্রেডার্স, এস এ ওয়েল এবং রুম্মন অ্যান্ড ব্রাদার্স।

জনতায় খেলাপি বেশি নতুন ঋণ
জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ গ্রাহকের কাছেই আটকা ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহকদের ঋণের বড় অংশই গত ১০ বছরে বিতরণ করা। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপের চৌধুরী নিটওয়্যার ও চৌধুরী টাওয়েলের যথাক্রমে ৪৬২ কোটি ও ১৬৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খাজা সোলায়মান চৌধুরী। এ ছাড়া ব্যাংকটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনায় এসেছে অ্যানোনটেক্স গ্রুপের সাড়ে ৫ হাজার কোটি ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের অনিয়ম নিয়ে।

জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সবই পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে বিতরণ করা হয়েছে। যেসব ঋণ খারাপ হয়ে গেছে, যোগাযোগের মাধ্যমে তা আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

জনতা ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিরা হলো চৌধুরী নিট ও টাওয়েল, এমবিএ গার্মেন্টস, ড্রাগন সোয়েটার, ড্রেজ বাংলা, দেশ টেলিভিশন, ওয়ান ডেনিম, সিক্স সিজন অ্যাপার্টমেন্ট, ল্যান্ড মার্ক ফেব্রিকস, আলী পেপার, টেকনো প্লাস্ট, কোয়ান্টাম পাওয়ার, ইনফ্রাটেক কোম্পানি, ফ্যাশন ক্র্যাফট নিট, ম্যাজেস্টিকা হোল্ডিংস, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, চয়েজ গার্মেন্টস, রেফকো ফার্মাসিউটিক্যাল, শাহনেওয়াজ জুট ও এমকে ট্রেড।

রূপালীর বড় খেলাপি নুরজাহান গ্রুপ
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ গ্রাহকের কাছে পাওনা ২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামভিত্তিক নুরজাহান গ্রুপ, যা বর্তমান সরকারের সময়ে অনুমোদন হয়। গ্রুপের চার প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৬৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেনিটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে পাওনা ২০৯ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির এমডি আতাউর রহমান প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সময়ে বিতরণ করা কেউ খেলাপি হয়নি। পুরোনো এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে গ্রাহকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।’

এই ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিরা হলো নুরজাহান গ্রুপ, বেনিটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইব্রাহিম কনসোর্টিয়াম, এএইচজেড এগ্রো, হিমালয় পেপার, চৌধুরী লেদার, এস এ গ্রুপের সামান্নাজ সুপার ওয়েল ও এস এ ওয়েল রিফাইনারি, জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং পেপারস, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ ব্রেকার্স, প্রাইস ক্লাব জেনারেল ট্রেডিং, এমবি স্পিনিং, দেশ জুয়েলার্স, জেড অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাপিটাল অ্যাসেটস, নিট ভ্যালি, নাসরিন জামান নিটওয়্যার, ডিএসএল সোয়েটার, শীতল এন্টারপ্রাইজ, এনডি প্রিন্টিং ও বায়োনিক সি ফুড।

খেলাপি ঋণের এই পরিস্থিতিতে চার ব্যাংকের সঙ্গে আগামী সোমবার সভা ডেকেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে এতে চার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত থাকবেন। ডিসেম্বরভিত্তিক আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরে এই সভায় ২০১৮ সালের জন্য ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। প্রায় এক দশক ধরে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে লক্ষ্য নির্ধারণ করে এসব ব্যাংক পরিচালিত হলেও কার্যত কোনো উন্নতি হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষকেরাও কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সরকার। বর্তমানে সরকার সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে না থেকে কিছু দুষ্টু ব্যাংক পরিচালকদের কথায় চলছে। ফলে ব্যাংকগুলোর কাঠামো ভেঙে পড়েছে। শীর্ষ খেলাপিদের থেকে সরকার মদদ তুলে নিলেই টাকা আদায় হবে।’
ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতটি নাজুক হয়ে পড়েছে। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এর উন্নতি হবে না।’