ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে শিথিল হলো আইন

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গভীর সংকটে পড়া নতুন অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এর ফলে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক ও একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সীমার বাইরে গিয়ে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কিনতে পারবে। পাশাপাশি এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা (এমডি) ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদের পরিচালক হতে পারবেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১২১ ধারার ক্ষমতা অনুযায়ী, আইনের তিনটি ধারার বিধান পরিপালন থেকে মূলধন জোগানদাতা পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে অব্যাহতি দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির। এর ফলে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী প্রতিটি ব্যাংকই ১৬৫ কোটি টাকা করে মোট ৬৬০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে ফারমার্স ব্যাংকে। এ ছাড়া ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) নতুন করে দেবে ৫৫ কোটি টাকা।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১২১ ধারা অনুযায়ী, সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ব্যাংক কোম্পানি আইনের যেকোনো ধারা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য শিথিল করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইনের সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের আইনের কয়েকটি ধারা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মূলত প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ফারমার্স ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে পারে সে জন্য।

আইনের বিশেষ ক্ষমতাবলে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় ও ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৪ (ক) ও ২৬ (ক)ধারার বিধান পালন থেকে সাধারণভাবে অব্যাহতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইনের ১৪ (ক) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের ১০ ভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করা যায় না। এ ছাড়া ২৬ (ক)ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক অন্য ব্যাংকের আদায়কৃত মূলধনের ১০ ভাগের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারে না। এ ছাড়া ধারণকৃত শেয়ার বাজারমূল্যে উক্ত ব্যাংকের আদায়কৃত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিংসের ৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না।

এ ছাড়া চার ব্যাংক ও আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা যাতে ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালক হওয়া সুযোগ পান, সে জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৩ (১) (ক) ধারা পরিপালন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের এ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিচালক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক অন্য ব্যাংকের পর্ষদের পরিচালক হতে পারেন না। কিন্তু এ ধারা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা এখন সেই সুযোগ পাবেন।

 যোগাযোগ করা হলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন হওয়ায় শিগগির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমরা ফারমার্সের পর্ষদে যোগ দিয়ে ব্যাংকটির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সব ধরনের নীতিমালার আধুনিকায়নে জোর দেব।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকটির মূলধন দেড় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে। বর্তমানে ব্যাংকটির মূলধন ৪০০ কোটি টাকা। চার ব্যাংক ও আইসিবি নতুন করে দেবে ৭১৫ কোটি টাকা। আর বাকি ৩৪০ কোটি টাকা বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করবে ফারমার্স ব্যাংক।

জানা গেছে, ব্যাংকটিকে পুনর্গঠন করতে কাজ করবে ১১ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ। এর মধ্যে চার ব্যাংক ও আইসিবির এমডি নতুন করে যুক্ত হবেন। আর চার পরিচালক আসবেন একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক থাকবেন দুজন। তবে ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে মূলত ব্যাংকটির পুনর্গঠনে মূল ভূমিকা পালন করবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা।

 ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরুর পর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চরম সংকটে পড়ে নতুন এ ব্যাংকটি, যা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ব্যাংক খাতে। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় গত নভেম্বরে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী।

এরপর নতুন পরিচালনা পর্ষদ এলেও ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় ব্যাংকটিকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে সরকার। এ জন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ।

সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়া ফারমার্স ব্যাংকের অনিরীক্ষিত বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে নতুন করে ব্যাংকটির আরও যেসব আর্থিক অনিয়ম বেরিয়ে আসছে, তা হিসাবে নিলে লোকসান বাড়বে কয়েক গুণ। বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি ফেরত না আসার আশঙ্কা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করা হয়েছে মূলত মতিঝিল ও গুলশান শাখার মাধ্যমে। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার ঋণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং   গুলশান শাখার ঋণ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর সময়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ‘ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের ভাগ নিয়েছেন তাঁরা। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।’ মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি।