গৃহঋণের জন্য অদ্ভুত পরিপত্র জারি

সরকারি ব্যাংক থেকে গৃহনির্মাণ ঋণ নেওয়ার বিষয়ে অদ্ভুত এক কাণ্ড করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সরকারি কর্মচারীদের বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য যখন একটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে, তার আগেই তড়িঘড়ি করে বিভাগটি শুধু নিজেদের জন্য আলাদা একটি নীতিমালা করেছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে (বিএইচবিএফসি) পাঠিয়েছে।

সরকারের যেকোনো বিভাগকেই এ ধরনের পরিপত্র জারির আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা নেয়নি বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
‘সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংকিং-ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহ-নির্মাণ ঋণ প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১৮’-এর একটি খসড়া গত মাসে তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ। অনুমোদনের জন্য এই খসড়া এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাওয়ার অপেক্ষায়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট বিভাগের জন্য বিশেষ সুবিধায় ঋণ দেওয়ার এই আয়োজন অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক। এই পরিপত্র বাতিল হওয়া জরুরি।’

অর্থ বিভাগের খসড়ায় বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৫ম থেকে ১ম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীদের জন্য সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা এবং ২০তম থেকে অষ্টাদশ গ্রেডের কর্মচারীর জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণসীমার কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে সচিব পর্যায়ের কর্মচারীরাও ঋণ পাবেন ৭৫ লাখ টাকা।
কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জারি করা গতকালের পরিপত্র বলছে, এ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত সহকারীরাই (পিও) পাবেন ৭৫ লাখ টাকা ঋণ। আর সচিব (মো. ইউনুসুর রহমান) ঋণ পাবেন ১ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে সচিব মো. ইউনুসুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সচিব ইউনুসুর রহমান সম্প্রতি বিদেশে থাকা অবস্থায় বেসিক ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন এ বিভাগের এমন একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পরিপত্রটির খসড়া তৈরি হয়। সচিব দেশে ফিরে এ তথ্য জেনে বিস্মিত হলেও তিনিই পরে বিভাগের একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে দেন। সচিবের সম্মতি ছাড়া কোনো পরিপত্র জারি হওয়ার সুযোগ নেই।

সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহ নির্মাণ ঋণের খসড়ায় সুদের হার ১০ শতাংশ ধরে নিয়ে ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাকি ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি আকারে দেবে।
কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরিপত্রে সুদের হার উল্লেখ না করে ব্যাংক হারে ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক হারের মানে হচ্ছে সুদের হার ৫ শতাংশ। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড) গড়ে ১০ শতাংশ। তাহলে বাকি ৫ শতাংশ খরচের কী হবে?
একটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিপত্র জারিটি যদি সত্যি হয়, তবে এই অন্যায্য পরিপত্রের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে তা বাতিল হওয়া। আর আমরা তার অপেক্ষায় আছি।’

পরিপত্র অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের স্থায়ী পদে পাঁচ বছর চাকরি করলেই কর্মচারীরা ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব ৯৫ লাখ এবং যুগ্ম সচিব ৯০ লাখ টাকা পাবেন। সব ধরনের ঋণের মেয়াদ ১৫ বছর।

তৈরি ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে পুরো অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যাবে। আর জমি কেনার জন্য মোট ঋণের ৪০ শতাংশ ব্যাংকগুলো আগে দেবে, ওই জমিতে বাড়ি তৈরির জন্য বাকি ৬০ শতাংশ দেবে চারটি সমান কিস্তিতে। জমি কেনা ও বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে এক বছর পর থেকে।

আর ফ্ল্যাট ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ছয় মাস পর থেকে। সব ধরনের ঋণের সুদের হার ৫ শতাংশ, যা হবে সরল সুদ, অর্থাৎ সুদের ওপর সুদ হবে না।
বিএনপি আমলে ১৯৯৪ সালে চালু হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে বাতিল করে দিয়েছিল। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বিভাগটি ফের চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার। শুরু থেকে বিশেষজ্ঞরা এ বিভাগ চালুর ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে সমালোচনা করলেও সরকার তাতে গুরুত্ব দেয়নি।