বিপুল সরবরাহে সওয়ার হয়ে ছুটেছে দামের পাগলা ঘোড়া

>
  • সবজি, মাংস, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ-রসুনের সরবরাহ বিপুল।
  • সরবরাহ বিপুল সত্ত্বেও দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের।
  • সরকারের দর মানে না কেউ
  • ক্রেতাদের অস্বস্তি বেড়েছে।

চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় পণ্যের দাম বেড়েছে—এ যুক্তি এ বছর খাটছে না। সবজির বাজার, মাংসের বাজার, ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজ-রসুনের বাজারে সরবরাহ বিপুল। তবু দাম বেড়েছে এসব নিত্যপণ্যের। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য জেলা থেকেও বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে।

বাড়তি সরবরাহের কারণে গত বুধবার রাতে কারওয়ান বাজারে বেগুনের দাম কমে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা বেগুন বিক্রি না করে বাজারেই মজুত করে রাখেন। কিন্তু খুচরা বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি বেগুনের দর উঠেছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ৫০ টাকা ছিল। একইভাবে দাম বেড়ে দেশি শসা প্রতি কেজি ৭০ টাকা ও মাঝারি লেবু প্রতি হালি ৪০ টাকায় উঠেছে। অন্যদিকে কারওয়ান বাজারের আড়তে যে কাঁচা মরিচ ২৫-৩০ টাকায় মিলছে, তা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়।

ফার্মের কক মুরগি ও মাছের দর আগে থেকেই চড়া। নতুন করে বেড়েছে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগির দর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) রোজা উপলক্ষে গরুর মাংসের দর প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও খুচরা বিক্রেতারা মাংস বিক্রি করছেন ৫০০ টাকা দরে, যা কয়েক দিন আগের তুলনায় ২০ টাকা বেশি। ব্রয়লার মুরগি কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকায় উঠেছে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ওই দামে সিটি করপোরেশনের মাংস কেনেন।

কারওয়ান বাজারের আড়তের সামনে বেগুন বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা। পাশে বস্তাভর্তি অবিক্রীত বেগুন। সরবরাহ বেশি থাকায় বুধবার রাতে অনেক বেগুন বিক্রি হয়নি।  ছবি: প্রথম আলো
কারওয়ান বাজারের আড়তের সামনে বেগুন বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা। পাশে বস্তাভর্তি অবিক্রীত বেগুন। সরবরাহ বেশি থাকায় বুধবার রাতে অনেক বেগুন বিক্রি হয়নি। ছবি: প্রথম আলো

সব মিলিয়ে রোজার বাজারে ক্রেতাদের অস্বস্তি আরও বাড়ল। এর আগে গত কয়েক দিনে সবজির দর প্রতি কেজি ৩০-৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৭০ টাকায় উঠেছে। মাছের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা, যদিও পণ্যটির দাম বিশ্ববাজারে কমেছে। ভোজ্যতেলের দাম বিশ্ববাজারে কমার সুফল হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীদের কমিশন বেড়েছে, ভোক্তারা সুফল পায়নি। ছোলার দামও যতটা কমার কথা, ততটা কমেনি। লবণে খুচরা বিক্রেতাদের কেজিতে ১০ টাকা মুনাফার সুযোগ দিচ্ছে কোম্পানিগুলো, কিন্তু ভোক্তাদের জন্য দাম কমাচ্ছে না।

এসবের মধ্যে ভোক্তার জন্য সুখবর চালের দামে। নতুন চাল উঠতে শুরু করায় সরু মিনিকেট ও মাঝারি চালের দাম কেজিতে তিন-চার টাকা কমেছে। অবশ্য নতুন চালের ভাত নরম হয়ে যায় বলে ক্রেতাদের কাছে তা বিশেষ পছন্দ নয়। ফলে তাদের পুরোনো চাল বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে।

আড়তে অবিক্রীত, খুচরায় দর দ্বিগুণ
বিভিন্ন জেলার পাইকারি হাট থেকে কিনে আনতে যে ব্যয় হয়েছে, কারওয়ান বাজারের আড়তে দাম তার চেয়ে কম। এ কারণে রমজান মাসের বিপুল চাহিদার বাজারেও বেগুন, শসা, কাঁচা মরিচ ও লেবু বিক্রি না করে রেখে দিয়েছেন ফড়িয়ারা। উদ্দেশ্য, বৃহস্পতিবার রাতের বাজার ধরা। পাইকারি বাজারের এই বিপুল সরবরাহের কোনো সুফল নেই খুচরা বাজারে। সেখানে রোজার বাড়তি চাহিদার সুযোগে ও রোজার বাজারের অজুহাত দেখিয়ে দ্বিগুণ দাম আদায় করছেন খুচরা বিক্রেতারা।

রোজা শুরুর আগের দিন গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারের খুচরাবিক্রেতারা ভালো মানের বেগুণ প্রতি কেজি ১০০ টাকা, তাজা ও কচি দেশি শসা ১২০ টাকা, সাধারণ দেশি শসা ৭০ টাকা, হাইব্রিড শসা ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৬০-৮০ টাকা এবং মাঝারি আকারের এক হালি লেবু ৪০ টাকা দাম চান। ফলে কয়েক দিন আগেও যে বেগুন ৫০ টাকা ছিল, তা এখন দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে শেওড়াপাড়ার বাসিন্দাদের। অন্যদিকে ৪০ টাকার শসা তাঁরা কিনতে পারছেন ৭০ টাকায়।

শেওড়াপাড়া বাজার থেকে দুপুর ১২টায় কারওয়ান বাজারে এসে সবজির আড়তের সামনে দেখা গেল লেবু ও কাঁচা মরিচ বিক্রেতাদের ভিড়। এক হালি ছোট লেবু তাঁরা ১০ টাকা, মাঝারি লেবু ১৫ টাকা ও বড় লেবু ২০-২৫ টাকায় বিক্রি করছেন। ‘আধা কেজি ২০, আধা কেজি ২০’-এমন হাঁক দিয়ে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা মরিচ। আর ৫০ টাকার মধ্যেই মিলছে ভালো মানের শসা। শেওড়াপাড়া বাজারে কেজি ৬০-৮০ টাকা শুনে কাঁচা মরিচ বিক্রেতা সুদেব বোস বলেন, ‘খুচরাওয়ালাগো কথা কইয়া লাভ নাই। রাইতে (বুধবার রাতে) কাঁচা মরিচ সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা পাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি করছি। সকালে প্রতি কেজি ২০ টাকায় বিক্রি হইছে।’ কারওয়ান বাজার আড়তে তাঁর মতো অনেক বিক্রেতাকে দেখা গেল, যাঁরা ডেকে ডেকে ১২০ টাকা পাল্লা দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি করছেন। প্রত্যেক বিক্রেতার পেছনেই বস্তায় বস্তায় মরিচ রাখা, যা আগের দিন রাতে বিক্রি শেষ হয়নি।

বিক্রেতারা জানান, বিক্রি শেষ না হলে অথবা সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণে দাম কমে গেলে কারওয়ান বাজার আড়তে এভাবেই নানা ধরনের সবজি রেখে দেওয়া হয়। রোজার বাজারে বাড়তি লাভের আশায় বুধবার বিপুল পরিমাণ বেগুন, শসা, কাঁচা মরিচ ও লেবু এসেছে, যার অনেকাংশই রয়ে গেছে।

খুচরা বিক্রেতা আনিসুর রহমান তাঁর দোকানে দাঁড়িয়েই বিশাল বিশাল কয়েকটি ঢিবি দেখিয়ে বলেন, ‘ওগুলো বেগুন। দাম কমে গেছে বলে ফড়িয়ারা তা বিক্রি করেননি।’ ঢাকার খুচরা বাজারগুলোতে বেশির ভাগ সবজির দর ৫০-৭০ টাকার মধ্যে, যা কিছুদিন আগেও ৩০-৫০ টাকার মধ্যে ছিল বলে দাবি বিক্রেতাদের। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজার বাজারে দাম বেড়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ের মতো ততটা নয়।

সরকারের দর মানে না কেউ
দুপুরের পর হাতিরপুল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পাইকারি দর ও যৌক্তিক খুচরা দরের একটি তালিকা টাঙিয়ে রেখেছে। এতে মুনাফাসহ প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের যৌক্তিক দর লেখা আছে ৩৬-৪২ টাকা। ওই বাজারে গতকাল কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় ৬০-৮০ টাকা দরে। একই বাজারে ৮০ টাকা কেজিতে বেগুন বিক্রি করতে দেখা যায়। আর শসা চাওয়া হয় ৬০-৭০ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী কোনো পণ্যই যৌক্তিক দরে বিক্রি করতে দেখা যায়নি হাতিরপুল বাজারে।

চট্টগ্রামে মুরগি ও মাংসের দাম বেড়েছে
চট্টগ্রাম থেকে প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানান, সেখানে বেড়ে গেছে মুরগি ও মাংসের দাম। এক সপ্তাহ আগে ফার্মের মুরগি বিক্রি হয়েছিল কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা করে। গতকাল সেই মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা করে। দেশি মুরগি গত সপ্তাহে ছিল ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা করে, এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ টাকা করে। এ ছাড়া গরুর মাংস গত সপ্তাহের তুলনায় ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে প্রকারভেদে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা করে। খাসি ও ছাগলের মাংসও একই হারে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৬৫০ ও ৭০০ টাকা করে।