গরিবের সংখ্যা বাড়ছে উত্তরের পাঁচ জেলায়

>
  • প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও দারিদ্র্য বেড়েছে রংপুর অঞ্চলে
  • দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রামে, কম নারায়ণগঞ্জে
  • উত্তরের সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আয়বৈষম্য তৈরি হয়েছে

উত্তরবঙ্গে গরিব মানুষ বেড়েছে। দেশে সবচেয়ে গরিব মানুষ এখন কুড়িগ্রামে। এই জেলার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই গরিব। এরপরই অবস্থান দিনাজপুরের। এই জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে ৬৪ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে গরিব মানুষ সবচেয়ে কম নারায়ণগঞ্জে, মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

দেশে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও একই সঙ্গে বাড়ছে আয়বৈষম্য। ফলে দারিদ্র্য বেড়ে গেছে রংপুর অঞ্চলে। আর এতে উত্তরের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। রংপুর বিভাগের দারিদ্র্যের হার এখন ঢাকা ও সিলেট বিভাগের চেয়ে তিন গুণ বেশি।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দারিদ্র্য বেশি, এমন ১০টি জেলার মধ্যে ৫টিই রংপুর বিভাগের। জেলাগুলো হলো কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গের একটি অংশে নতুন করে দারিদ্র্যের তীব্রতা ফিরে এসেছে। তালিকায় থাকা অন্য জেলাগুলো হলো বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও মাগুরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আয় ও ব্যয় খানা জরিপ এবং দারিদ্র্য মানচিত্র প্রতিবেদনে এই চিত্র পাওয়া গেছে। দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি প্রকাশিত এই জরিপ বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে উত্তরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা গরিব পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে না। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সহায়ক হচ্ছে না।

উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসির চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত উত্তরবঙ্গে যে মঙ্গা ছিল, তাতে বড় পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তবু কেন ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য বাড়ছে, এটা একধরনের ধাঁধার মতো। ৬ থেকে ৭ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি পরও কেন ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমছে না? তাই প্রবৃদ্ধির ধরন নিয়ে প্রশ্ন আসছে। দেখা যাচ্ছে, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের ফলে প্রাথমিকভাবে এত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু এই রাস্তাঘাট ব্যবহার করে নতুন কোনো বিনিয়োগ আসছে না। ফলে প্রবৃদ্ধির সুফল তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। এসব বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন।

রংপুর ও রাজশাহীর হাল
বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ, ছয় বছর পর ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র্য ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে প্রায় ২৯ শতাংশ হয়েছে। এর মানে হলো রাজশাহী অঞ্চলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি খুব বেশি বদলায়নি।

রংপুর বিভাগে মোট আটটি জেলা আছে। ছয় বছরের ব্যবধানে কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, লালমনিরহাটের দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার দিনাজপুরে আগে ছিল ৩৮ শতাংশ, এখন হয়েছে ৬৪ শতাংশ। কুড়িগ্রামে ৬৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭১ শতাংশ হয়েছে। আর লালমনিরহাটে সাড়ে ৩৪ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশ হয়েছে। বিভাগের অন্য পাঁচটি জেলায় দারিদ্র্য পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি,২-৩ শতাংশের মতো দারিদ্র্য কমেছে। দারিদ্র্যের হার এখন রংপুরে ৪৪ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৪৭ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ, পঞ্চগড়ে ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ ও নীলফামারীতে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ।

রাজশাহী বিভাগে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে সার্বিকভাবে দারিদ্র্য পরিস্থিতি প্রায় অপরিবর্তিত আছে। তবে জেলাওয়ারি দারিদ্র্যের বেশ উত্থান-পতন হয়েছে। কোনো কোনো জেলায় দারিদ্র্য বেশ কমেছে, আবার কোনো জেলায় দারিদ্র্য বেশ বেড়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বগুড়া, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় দারিদ্র্য অনেক বেড়েছে। ছয় বছরের ব্যবধানে নওগাঁ জেলায় দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়ে ৩২ শতাংশ পেরিয়ে গেছে।

আবার কমতির হিসাবে দেখা গেছে, রাজশাহী জেলায় প্রায় ১২ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে দারিদ্র্যের হার এখন ২০ শতাংশ। এ ছাড়া এই বিভাগের অন্য জেলা নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাটে ৩-৪ শতাংশীয় পয়েন্ট দারিদ্র্য কমেছে।

সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রামে, কম নারায়ণগঞ্জে
কুড়িগ্রাম জেলায় মানুষের বড় অংশই নিজেদের পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত খাবার কিনতে পারে না। আবার দৈনন্দিন চাহিদা, যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বস্ত্র-এসবেও খরচ করার সুযোগ কম। এই জেলার দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। জেলার কোথাও কোথাও দারিদ্র্যের হার ৭৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে কোথাও ৬৪ শতাংশের নিচে দারিদ্র্যের হার নেই।

অন্যদিকে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ জেলার দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম, ২ দশমিক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই জেলার ৯৭ শতাংশের বেশি অধিবাসী দারিদ্র্যসীমার ওপরে বাস করে। স্থানভেদে এই জেলার দারিদ্র্যের সর্বোচ্চ হার সাড়ে ৪ শতাংশ; সর্বনিম্ন দশমিক ৬ শতাংশ।

খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ অনুযায়ী গত ছয় বছরে দারিদ্র্যের সার্বিক হার সাড়ে ৩১ শতাংশ থেকে কমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হারও কমেছে। ২০১৬ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২০ লাখ। সেই হিসাবে দেশে ৩ কোটি ৯৩ লাখ দরিদ্র মানুষ আছে।

মূলত ধনী-গরিবনির্বিশেষে আয় বৃদ্ধির কারণেই সার্বিক দারিদ্র্য কমেছে। এ দেশের একটি পরিবারের গড় আয় ছয় বছরের ব্যবধানে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বেড়েছে। এখন একটি পরিবারের গড় আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। তবে এই আয় বৃদ্ধির দৌড়ে গরিবের চেয়ে ধনীরাই বেশি এগিয়ে আছে। অর্থাৎ আয়ের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের বৈষম্য। যেমন দেশের সব মানুষের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করে ওপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী মানুষ। ছয় বছর আগে তাদের আয়ের পরিমাণ ছিল মোট আয়ের ৩৫ শতাংশের মতো। অন্যদিকে এখন মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশের সমান আয় করে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। ছয় বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল মোট আয়ের ২ শতাংশ।