ভ্যাটের মতো শুল্ক আইনও পিছিয়ে যাচ্ছে

চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাসের সময় নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। মূলত ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিকল্পনা ছিল, আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে অধিবেশনে নতুন কাস্টমস আইনটি পাস করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে এনবিআরকে।

জানা গেছে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে তা জাতীয় সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করা হচ্ছে না। অর্থাৎ নতুন কাস্টমস আইনটি আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর হচ্ছে না। এর ফলে পুরোনো আইন দিয়ে চলবে শুল্ক আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম। চার বছর আগে মন্ত্রিপরিষদ সভায় কাস্টমস আইনটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ চার বছর পার হলেও আইনটি চূড়ান্ত করতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেনি এনবিআর।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নতুন কাস্টমস আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। সেখানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শুল্কায়ন ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। যেমন ইকোনমিক অথরাইজড অপারেটর, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো, পোস্ট অডিট ক্লিয়ারেন্স, অগ্রিম বিল অব এন্ট্রি দাখিল, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা—এসব বিষয় রাখা হয়েছে। নতুন আইনটি মূলত আধুনিক প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে করা হয়েছে। এই আইনটি হলে সৎ ব্যবসায়ীরা সহজে পণ্য খালাস করতে পারবেন। এক জায়গায় সব কাজ করতে পারবেন তাঁরা। এমনকি আস্থার ভিত্তিতে গ্রিন চ্যানেল দিয়ে পণ্য খালাস করে নিয়ে যাবেন তাঁরা। সার্বিকভাবে ব্যবসায় পরিবেশ সহজ হবে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কাস্টমস আইনটির খসড়া বাংলা ভাষায় তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু এই আইনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হবে, তাই বিদেশিদের জন্য এটি এখন ইংরেজিতে অনুবাদের কাজ চলছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এ আইনের খসড়া দীর্ঘ সময়েও ইংরেজিতে অনুবাদ না করায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জানা গেছে, কাস্টমস আইনটি এখন ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। ভেটিং শেষে আবার মন্ত্রিপরিষদ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উঠবে সেটি। পরে তা পাস করার জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। তবে সংসদ সদস্যরা চাইলে আইনটি আরও পর্যালোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠাতে পারবেন। এদিকে ৭ জুন আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট দেবেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে এত অল্প সময়ে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপন করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জানতে চাইলে এনবিআরের দায়িত্বশীল এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বাজেট অধিবেশনে এই আইন উত্থাপন করার সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া আইনটির ওপর আলোচনা করে পাস করতে হবে। আইনটি বাস্তবায়নে এনবিআরের যথেষ্ট প্রস্তুতি দরকার।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর নতুন কাস্টমস আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১২ সালে এ নিয়ে কাজ শুরু করে এনবিআর। পরে আইনের খসড়াটি ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রিপরিষদ সভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে সে সময় কিছু পর্যবেক্ষণও দেওয়া হয়। বর্তমানে ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলছে।
এদিকে নতুন কাস্টমস আইন তৈরির পাশাপাশি গত জুলাই থেকে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ২০১৩ সালে ভ্যাট আইনটি সংসদে পাস করা হয়। তবে প্রস্তুতির জন্য কয়েক বছর সময় দিয়ে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে আইনটি বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভ্যাট হারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার কারণে আইনটির বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমান সরকারের এই মেয়াদের শেষ বাজেটে এখন কাস্টমস আইনটি পাস করার বিষয়টিও পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের মধ্যেই সংস্কারের ইচ্ছা নেই। নতুন ভ্যাট আইন ও কাস্টমস আইন বাস্তবায়নের মতো সংস্কার ছাড়া কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা সম্ভব নয়। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের জন্য বেগবান অর্থনীতি চালাতে হলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লাগবে। তাই ওই দুটি আইন বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, কাস্টমস আইন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিদেশিদের সঙ্গেই এসব ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। তাই কাস্টমস আইনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে নেওয়া উচিত।

এনবিআরের বেশ কয়েকজন শুল্ক কর্মকর্তা বলেন, ‘আধুনিক শুল্ক প্রশাসন দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ পণ্যের চালান ছেড়ে দিতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের এখানে দুই-তিন দিন সময় লেগে যায়।’
নতুন কাস্টমস আইনটি প্রণয়নের তাগিদ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকেই এসেছে। মূলত বিশ্ব মানদণ্ডে শুল্ক প্রশাসনকে নিয়ে যেতেই নতুন আইন করা হয়েছে।
২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন হারমোনাইজেশন অ্যান্ড সিম্পলিফিকেশন অব কাস্টমস প্রসিডিউরস বা সংশোধিত কিয়োটো স্মারকে সই করে বাংলাদেশ, যা আধুনিক কাস্টমসের নকশা হিসেবে পরিচিত। এরপর ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্টে সই করে বাংলাদেশ।