কড়া নজরে থাকবেন চাকরিজীবীরা

>
  • নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে-কে আয়কর রিটার্ন দিল, কে দেয়নি।
  • যাঁরা রিটার্ন দেননি, তাঁদের খুঁজে নেবে এনবিআর
  • এনবিআরের কাছে এই বেসরকারি চাকরিজীবীরাই যেন ‘সোনার খনি’

বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সুখবর নেই। বরং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নজর এবার বেশি থাকবে এই বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর। নিয়োগ প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে, ওই প্রতিষ্ঠানের কোন কোন কর্মী বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিয়েছেন, কারা দেননি। এরপর যাঁরা রিটার্ন দেননি, তাঁদের খুঁজে নেবে এনবিআর। রিটার্ন না দিলে জরিমানা করতে পারবেন কর কর্মকর্তারা।

এদিকে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কর্মীদের এই ধরনের তালিকা এনবিআরে জমা না দেয়, তবে ওই প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিরীক্ষা করবে এনবিআর। সব মিলিয়ে এনবিআরের কাছে এই বেসরকারি চাকরিজীবীরাই যেন ‘সোনার খনি’। কর আদায়ের লক্ষ্য যেন তাঁরাই। অবশ্য আয় করলে কর দিতেই হবে।

এ বছর করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা হয়নি। আগের মতোই আড়াই লাখ টাকা বহাল রাখা হয়েছে। এর ফলে কোনো বেসরকারি চাকরিজীবীর মূল বেতন যদি মাসে কমবেশি ১৮ হাজার টাকা হয়, তবে অবশ্যই কর দিতে হবে। এতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের বহু বেসরকারি চাকরিজীবী করের আওতায় চলে আসবেন।

এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, মূলত চাকরিজীবীদের কর জালে আনতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেকেই আয় করেন, কিন্তু কর দিতে উৎসাহ দেখান না।

দুই বছর আগে প্রথমবারের মতো বেসরকারি চাকরিজীবীদের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। গতবার তাঁদের বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমাও বাধ্যতামূলক করা হয়। যেসব কর্মীর টিআইএন থাকবে না, রিটার্ন জমা দেবেন না—তাঁদের বেতন-ভাতায় যে টাকা দেওয়া হবে, সেই টাকা ওই নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান তাঁদের আয়-ব্যয় বিবরণীতে খরচ হিসাবে দেখাতে পারবে না। তখন এনবিআরের যুক্তি ছিল, অনেক কোম্পানি প্রকৃত বেতনভুক্ত কর্মীর চেয়ে বেশি কর্মী দেখায়। এ ধরনের ‘ভৌতিক কর্মী’ দেখিয়ে ওই কোম্পানির আয়কর বিবরণীতে বেতন খাতে বেশি খরচ দেখানো হয়। মূলত খরচ বেশি দেখিয়ে আর আয় কম দেখিয়ে কর ফাঁকির সুযোগ নিতেই এটা করা হয়।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে টিআইএন নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ৭ থেকে ৮ লাখ এমন নতুন করদাতা পেয়েছে এনবিআর। এখন ওই সব করদাতার কাছ থেকে কর আদায়ে মনোযোগী হয়েছে। তাই সরাসরি চাকরিজীবীদের না ধরে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে।

কর্মীদের রিটার্ন জমা নিশ্চিত করতে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকে তিন ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে রাখতে চায় এনবিআর। এ জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ৭৫ (এ), ১০৮ ও ১০৮ (এ) ধারা প্রতিপালন নিশ্চিত করার কথা বলেছে এনবিআর। এসব ধারা যদি ওই সব প্রতিষ্ঠান না মানে, তবে অবশ্যই ওই সব প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় বিবরণী নিরীক্ষা করা হবে।

আয়কর অধ্যাদেশে ১০৮ (এ) ধারা সংযোজন করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, প্রতিবছর এপ্রিল মাসের মধ্যে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে, ওই প্রতিষ্ঠানের কারা রিটার্ন দিয়েছেন, কারা দেননি। কর্মীদের নাম জানাতে হবে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, যাঁরা রিটার্ন জমা দেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ছাড়া আয়কর অধ্যাদেশের ৭৫ (এ) ও ১০৮ ধারাও মানতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৭৫ (এ) ধারা অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠান যত ধরনের উৎসে কর আহরণ করে, তার বিবরণী বা রিটার্ন জমা দিতে হবে। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন-ভাতা থেকে পে রোল কর হিসেবে যে কর কেটে রাখা হচ্ছে, তা-ও সেখানে থাকবে। এই বিবরণী বছরে একবার দিতে হয়।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে যত আয়কর আদায় হয়, এর মধ্যে তিন শতাংশের মতো আসে পে রোল কর বাবদ। এই পে রোল কর আদায়ের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যবস্থা। প্রতি মাসে যে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, এর আনুমানিক হিসাব করে অগ্রিম কর বা উৎসে কর হিসেবে কেটে রাখে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। পরে ওই অর্থ এনবিআরে জমা দেওয়া হয়।

১০৮ ধারা অনুযায়ী, আয়-ব্যয় বিবরণী বছরে একবার জমা দিতেই হবে। সেখানে কোন কর্মীকে কত বেতন দেওয়া হলো—এর বিবরণী থাকে। অবশ্য প্রতিষ্ঠানের অন্য খরচ বিবরণীও সেখানে থাকে।

বর্তমানে প্রায় ৩৩ লাখ টিআইএনধারী আছেন। তাঁদের মধ্যে বছরে রিটার্ন জমা দেন গড়ে ১৪-১৫ লাখ করদাতা। ইতিমধ্যে বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে আগামী পাঁচ বছরে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটিতে উন্নীত করবেন। আর একই সময়ে রিটার্ন জমাকারী বৃদ্ধির লক্ষ্য ৮০ লাখ।