যেসব দেশে নারীদের ব্যাংক হিসাব বেশি

বিশ্বে মাত্র ছয়টি দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর ব্যাংক হিসাব বেশি রয়েছে। দেশগুলো হলো আর্জেন্টিনা, জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপাইনস।
বিশ্বে মাত্র ছয়টি দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর ব্যাংক হিসাব বেশি রয়েছে। দেশগুলো হলো আর্জেন্টিনা, জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপাইনস।

বিশ্বে মাত্র ছয়টি দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর ব্যাংক হিসাব বেশি রয়েছে। দেশগুলো হলো আর্জেন্টিনা, জর্জিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপাইনস।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ফিনডেক্স রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি অনলাইন। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে ১৪০টি দেশের মানুষের ব্যাংকিং কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। দেখা হয়, প্রাপ্তবয়স্করা কীভাবে ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন করেন, সঞ্চয় করেন ও ঋণ নেন এবং সেই সঙ্গে ঝুঁকি মোকাবিলা করেন। বর্তমানে বিশ্বে ৬৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের ব্যাংকে হিসাব রয়েছে, ২০১১ সালে যা ছিল ৫১ শতাংশ। এ ছাড়া এই জনগোষ্ঠী মোবাইলেও ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। গত সাত বছরে বিশ্বে ১২০ কোটি জনগোষ্ঠী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম শুরু করলেও নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়েই রয়েছেন।

বিশ্বে ৭২ শতাংশ পুরুষের ব্যাংক হিসাব রয়েছে, নারীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ বৈশ্বিক ব্যবধানটা ৭ শতাংশ। ২০১১ সাল থেকে এই ৭ শতাংশ ব্যবধান রয়েছে। তবে ব্যবধানটা গড়ে ৭ শতাংশ। কারণ, কোনো কোনো দেশে বৈষম্য অনেক বেশি আবার কোনো কোনো দেশে কম। উন্নত দেশে ব্যাংক হিসাবের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের ব্যবধান অনেক কম। আবার উন্নয়নশীল দেশে ৬৭ শতাংশ পুরুষের ব্যাংক হিসাব রয়েছে, অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে তা ৫৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যবধানটা প্রায় ৮ শতাংশের মতো।

প্রকৃতপক্ষে, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের অ্যাকাউন্ট মালিকানায় লিঙ্গ ব্যবধান রয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও তুরস্কে ব্যাংক হিসাবে পুরুষ ও নারীর ব্যবধান প্রায় ৩০ শতাংশের মতো। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেবার বাইরে যত মানুষ রয়েছে, তার ৬৫ শতাংশ নারী। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সময়ে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হার প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছে। অথচ ব্যবধানটা তারপরও এত বেশি। মরক্কো, মোজাম্বিক, পেরু, রুয়ান্ডা, জাম্বিয়ার মতো দেশগুলোতেও এ ব্যবধান ২ অঙ্কের ঘরে। তবে ব্যবধানটা বেশ লক্ষণীয় কম ভারতে। ভারতে ব্যাংক হিসাব রয়েছে ৮৩ শতাংশ পুরুষের। নারীদের ক্ষেত্রে তা ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যবধান এখানে কমে এসেছে ৬ শতাংশে। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল যেমন কম্বোডিয়া, মিয়ানমার এবং ইউরোপ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার আজারবাইজান, বেলারুশ, কিরগিজ রিপাবলিক ও রাশিয়ান ফেডারেশনে এই ব্যবধান খুবই কম। বলিভিয়া, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামেও উল্লেখযোগ্য ব্যবধান নেই।

তবে নারী ও পুরুষের ব্যাংক হিসাবের এই ব্যবধান বিশ্বজুড়ে থাকলেও ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার ছয়টি দেশে উল্টো চিত্র এল কীভাবে? তারা কীভাবে বৈষম্যকে অতিক্রম করল? বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ লরা কেপলার বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। তিনি কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দিয়েছেন।

কেপলার তাঁর পর্যবেক্ষণে পান, ফিলিপাইনের নারীরা পুরুষের চেয়ে বিদেশে চাকরি করেন বেশি। বিদেশে কাজ করার সুবাদে ওই নারীদের ব্যাংক হিসাব খুলতেই হয়। তাঁরা দেশে টাকা পাঠান। পরিবার চালান।

লাওস বাদে বাকি পাঁচটি দেশেই সরকারি প্রোগ্রামগুলোয় নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মঙ্গোলিয়ার কথা। মঙ্গোলিয়ার ৪৩ শতাংশ নারী ক্যাশ ট্রান্সফারের মাধ্যমে বেতন গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, মাত্র ২৪ শতাংশ পুরুষ এভাবে বেতন নেন। ইন্দোনেশিয়াতে চলমান হিসাব ও যেসব হিসাবে গত বছর একবার হলেও অর্থ ওঠানো হয়েছে বা ঢোকানো হয়েছে, এমন হিসাবে কোনো লিঙ্গবৈষম্য নেই।

তবে নারীদের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, তা হলো সরকারি প্রোগ্রামের অর্থ তারা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে নিচ্ছেন ঠিকই তবে তা ফুরিয়ে গেলে ওই হিসাবে অন্য কাজ করেন না। ফিলিপাইনই একমাত্র দেশ, যেখানে পুরুষের চেয়ে নারীদের সচল হিসাব বেশি রয়েছে। ২০১৭ সালে আফগানিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় নারী-পুরুষ মিলিয়ে এক-তৃতীয়াংশ অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় ছিল। ভারতে এই হার অর্ধেক পাওয়া গেছে। ভারতের আর্থিক খাতে নতুন সংস্কার এবং দ্রুত নতুন করে কৃষকদের ব্যাংকিং সেবার নিয়ে আসায় নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেশি হয়েছে। এগুলো সচল হলে এই হার কমে আসবে। তবে পাকিস্তানে এই হার মাত্র ১৩ শতাংশ।

লরা কেপলার বলেন, ভারত ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে লিঙ্গ-পার্থক্য অনেকটা কমিয়ে এনেছে, তবে নারীদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবে অন্তত অর্ধেক নিষ্ক্রিয়। আর এটিই এখন ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে নারী-পুরুষের ব্যাংক হিসাবে এত ব্যবধান কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কম থাকার বিষয়টি মূলত ‘কারণ’ ও ‘প্রভাব’ দিয়ে বোঝানো যায়। অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই বলে ব্যাংকের লেনদেনে নারীরা যান না আবার ব্যাংকের লেনদেন যান না বলে নারীর সক্ষমতা হচ্ছে না। অর্থাৎ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন কম বলেই ব্যাংকে হিসাব কম।

বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, দেশের কর্মক্ষম নারীর ৩৬ শতাংশ এখন শ্রমবাজারে আছেন। ৬৪ শতাংশ নারীর নিজের আয় নাই। যেহেতু আয় নেই, তাই টাকার অঙ্কের হিসাবও নেই। আবার যাঁরা শ্রমবাজারে আছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, নিজের আয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁরা পান না। অনেক ক্ষেত্রেই উপার্জনের টাকা স্বামী বা অভিভাবকের হাতে তুলে দেন। ফলে নিজের লেনদেন নিজে করেন না। ব্যাংকে হিসাব খোলেন না।

ব্যাংক হিসাব না থাকায় বাংলাদেশের নতুন নারী উদ্যোক্তারা সমস্যায় পড়েন জানিয়ে নাজনীন আহমেদ বলেন, কেবল ব্যাংকে হিসাব না থাকায় একজন নতুন নারী উদ্যোক্তা এক থেকে থেকে বছর পিছিয়ে পড়েন। ধরা যাক, একটি মেয়ে প্রথমবারের মতো নিজে কিছু করার চেষ্টা করছেন। তিনি ব্যাংকে হিসাব খুললেন। কিন্তু ওই হিসাব তাঁকে এক থেকে ছয় বছর চালিয়ে নিতে হয়, তারপর তিনি ঋণ বা ব্যাংক সুবিধা পান। তাই প্রতিটি মেয়ে, আসলে সবাইকে ছাত্রাবস্থায় এসব পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।