শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ

>

•বাজেট বরাদ্দ
•জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যয় প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপের চেয়েও কম।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এ দুটি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে সম্প্রতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বেড়েছে বটে। তবে মোট বাজেটে এ দুটি খাতের হিস্যা কমেছে। ফলে জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ আগের মতোই নিম্নস্তরে রয়ে গেছে।

এদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অনুপাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের একটি চিত্র উঠে এসেছে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (এসকাপ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনটি গত ৮ মে প্রকাশ করা হয়। এতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এসকাপের প্রতিবেদনটিতে ৩৬টি দেশের শিক্ষা খাতের ব্যয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করে, যা ওই দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের চেয়ে কম ব্যয় করে শুধু কম্বোডিয়া। পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ। ভারতে তা ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এই খাতে নিউজিল্যান্ড ব্যয় করে জিডিপির প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করত। সেটা সর্বশেষ বাজেটে কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে এসেছে। এর মানে হলো, দেশের জিডিপির আকার বেড়েছে। সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। ফলে জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্যে ব্যয় কমেছে। প্রতিবেদনে ৪৮টি দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশই এত কম হারে ব্যয় করে না। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৯ শতাংশের বেশি ব্যয় করে।

সার্বিকভাবে জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়ন যদি টেকসই করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের অবস্থানে থাকার সময় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে। তার সুফল এখন তারা পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মুখে বলছি, বাস্তবে করছি না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।’

নতুন বাজেটে শিক্ষা খাত
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয়ের একটি বিশ্লেষণ করেছে। তাদের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৪ শতাংশ দেওয়া হয়েছে। এটি চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের বরাদ্দের চেয়ে কম। সংশোধিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। নতুন বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে ২ দশমিক ০৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের সমান। তবে গত চার বাজেটের মধ্যে এই হার সর্বনিম্ন। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ দশমিক ৮৪ শতাংশে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, নতুন বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় ৫৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি।

দেশের শিশুরা এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন আছে। এ দেশে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিদেশিরা বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে কাজ করছেন। এ ছাড়া মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে আর দেশে ফিরছেন না।

বাজেট ঘোষণার পরদিন সিপিডির বিশ্লেষণে সংস্থাটির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শিক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে বলেন, শিক্ষায় এত কম বরাদ্দ দিয়ে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, দক্ষ শ্রমশক্তি নিশ্চিত করার আশা বাতুলতা।

স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ
নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের হিস্যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে কমেছে। সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে এই খাতের জন্য ২০ হাজার ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে নতুন বাজেটে মোট ব্যয়ের ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে স্বাস্থ্য খাত, যা সংশোধিত বাজেটে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরে এই হার ১ দশমিক ০৪ শতাংশে উন্নীত করার কথা ছিল। নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাত পরিবহন ও যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং কৃষির চেয়ে কম বরাদ্দ পেয়েছে।

সেলিম রায়হান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের সাফল্য আছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পেরেছে। তবে সেটা সম্ভব হয়েছে সস্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। স্বাস্থ্য খাতে নতুন যেসব সমস্যা আসছে, তাতে বরাদ্দ ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে। এ দেশের মানুষের বড় একটা অংশের চিকিৎসার জন্য ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটারও স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকারের সঙ্গে যোগ আছে।