ইন্টারনেটে ভ্যাট কমানো হলেও সুফল পাচ্ছেন না গ্রাহক

গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার ১০ শতাংশ কমানোর সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ ব্যবহারকারীরা। কারণ, ইন্টারনেটের ভ্যাট হার কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে পরিপত্র জারি করেছে, সেখানে মোবাইল ইন্টারনেটকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ দেশের ৯৩ শতাংশ ব্যবহারকারী মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এনবিআরের পরিপত্রের সুযোগ নিয়ে মোবাইল অপারেটররা গ্রাহকের কাছে আগের দরেই ভ্যাট আদায় করছে।

গত ২৮ জুন সংসদে বাজেট পাস হওয়ার পর খুচরা পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা মূল্যের ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন অপারেটররা গ্রাহকের কাছে আগের ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট আদায় করছে। এর যুক্তি হিসেবে তারা বলছে, ভ্যাট কমানোর বিষয়ে এনবিআর যে পরিপত্র জারি করেছে, সেখানে মোবাইল ইন্টারনেটের ভ্যাট কমানোর নির্দেশনা নেই।

অন্যদিকে, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো (আইএসপি) বলছে, গ্রাহক পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ করা হলেও তাদের সেবা দেওয়ার খরচ উল্টো বেড়েছে। কারণ, আইএসপিদের এনটিটিএন (নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) সেবার ভ্যাট ১৫ শতাংশ ও আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। এত দিন দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আইএসপিদের ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ ছিল। আইআইজিদের কাছে পাইকারি দামে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কেনে আইএসপিরা। আর এই ব্যান্ডউইথ এনটিটিএনদের অবকাঠামোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছানো হয়।

ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ হওয়ায় দুই ক্ষেত্রেই আইএসপিরা এত দিন কর রেয়াত (রিবেট) পেত। এবারের বাজেটে রেয়াত-সুবিধা বাতিল করে এনটিটিএন সেবার ওপর ১৫ শতাংশ এবং আইআইজির ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য করা হয়েছে। এতে আইএসপিদের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কেনা ও পরিবহনের খরচ বেড়ে গেছে। আইএসপিদের ভাষ্য, এখন যে দামে ইন্টারনেট বিক্রি হচ্ছে, ভ্যাটের জটিলতা দূর না হলে ইন্টারনেটের দাম অন্তত আগের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, এনটিটিএন ও আইআইজির ভ্যাটের কারণে ইন্টারনেট কিনতে খরচ বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে দাম বাড়িয়েই বিক্রি করতে হবে। তাই গ্রাহকের ইন্টারনেট সেবার ভ্যাট হার ৫ শতাংশ হলেও এর দাম কমবে না। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর এই সমস্যার সমাধান না করলে অচিরেই দাম বাড়বে ইন্টারনেটের।

মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) যুক্তি হলো, ভ্যাট বিষয়ে এনবিআর যে পরিপত্র জারি করেছে, সেখানে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোড উল্লেখ না করায় তারা ইন্টারনেটের ভ্যাট ১৫ শতাংশই রাখছে। এ বিষয়ে এনবিআরের জারি করা পরিপত্রে ইন্টারনেট সংস্থার ‘এস ০১২’ সার্ভিস কোডের আওতায় ‘এস ১২.১৪’ কোডের জন্যই শুধু এই নির্দেশনা কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে, যা শুধু আইএসপিগুলোর ক্ষেত্রে কার্যকর। মোবাইল ফোন অপারেটরদের এ-সংক্রান্ত কোড হলো ‘এস ১২.১০’। যেহেতু পরিপত্রে তাদের কোড নেই, তাই অপারেটরদের পক্ষে ইন্টারনেটের ভ্যাট কমানোর এই নির্দেশনা পালন করা সম্ভব নয়।

অ্যামটবের মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, ইন্টারনেটের ভ্যাট হার কমিয়ে আনার যে সিদ্ধান্ত, তা আদৌ মোবাইল অপারেটরদের জন্য কার্যকরী হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে পরিষ্কার হওয়ার জন্য মোবাইল ফোন অপারেটররা সম্প্রতি এনবিআরের কাছে চিঠি দিয়েছে।

জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য রেজাউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব ক্ষতি সত্ত্বেও বৃহত্তর স্বার্থে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের ভ্যাট হার কমানোর জন্য পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কী সমস্যা, সেটা তারা পরিষ্কার করে জানায়নি। তাদের বক্তব্য জানার পরে এ বিষয়ে এনবিআর পরবর্তী উদ্যোগ নেবে।

টেলিযোগাযোগ-বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু সাইদ খান বলেন, এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার খামখেয়ালিপনার কারণে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের বছরে কৃত্রিমভাবে এ সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে সরকার বিব্রত হয়। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার পরেও এ বিষয়ে কোনো জটিলতা কাম্য নয়।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৬৮ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ১১ লাখ, যা মোট ব্যবহারকারীর ৯৩ শতাংশের বেশি।