খাত বড়, মজুরি কম

দেশের ট্যানারিশ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া জাহাজভাঙা শিল্পে ১৬ হাজার এবং ওষুধশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ৫০ টাকা। চলতি মাসেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানার শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি শতভাগ বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ৩০০ টাকা ঘোষণা করেছে সরকার। মজুরির সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা যোগ করলে মাস শেষে বেতন-ভাতা ১৪ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

ট্যানারি, জাহাজভাঙা ও ওষুধশিল্পের চেয়ে অনেক বড় এবং ব্যবসাসফল খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। দেশের পণ্য রপ্তানির সাড়ে ৮৩ শতাংশ পোশাক খাত থেকে আসছে। তবে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার বা আড়াই লাখ কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের এই খাতের শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি উল্লেখযোগ্য অন্য খাতের তুলনায় বেশ কম।

বর্তমানে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা। গত সপ্তাহে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সভায় পোশাকশিল্পের মালিকেরা মজুরি মাত্র ১ হাজার ৬০ টাকা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেন। সব মিলিয়ে তাঁরা মজুরি ৬ হাজার ৩০০ টাকা দিতে চান। অন্যদিকে শ্রমিকপক্ষ ১২ হাজার ২০ টাকা মজুরি দাবি করেছে।

শ্রম মন্ত্রণালয় গত ৩১ জানুয়ারি পোশাকশিল্পের মজুরি বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৬ জুলাই তৃতীয় সভায় নিজেদের মজুরি প্রস্তাব দেয় মালিক ও শ্রমিকপক্ষ। কম মজুরির প্রস্তাবের পক্ষে মালিকপক্ষ লিখিত যুক্তি দিয়েছে, প্রতিযোগী অন্য দেশের চেয়ে পোশাকশ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম।

উভয় পক্ষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে মানববন্ধন ও সভা-সমাবেশ করছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার বিকেলে শাহবাগে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশ করেন।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মালিকপক্ষ যে মজুরি প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে বড় ধরনের সমন্বয়ের সুযোগ আছে। কারণ, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। সেটি বিবেচনায় নিলে মজুরি হয় ৭ হাজার টাকা। আবার শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় নিলেও মজুরি অনেক বাড়বে। তাই মালিকপক্ষের নিজেদের প্রস্তাব নতুন করে বিবেচনা করে মজুরি বোর্ডে জমা দেওয়া উচিত।

সিপিডির এই গবেষক বলেন, ‘বিজিএমইএ পোশাকশ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ৪০ শতাংশ বললেও আমরা গবেষণায় দেখেছি, উৎপাদনশীলতা ৫০ শতাংশের ওপরে। সেটি ধীরে ধীরে বাড়ছে।’

 অনেক খাতে মজুরি বেশি

নিম্নতম মজুরি বোর্ড দেশের ৪১টি খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করেছে। তার মধ্যে গত বছর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ট্যানারি, জাহাজভাঙা, ওষুধ, টি প্যাকেটিং, কটন টেক্সটাইলসহ ৯টি খাতের মজুরি নির্ধারণ করেছে মজুরি বোর্ড। এর মধ্যে ট্যানারিতে ১২ হাজার ৮০০, জাহাজভাঙায় ১৬ হাজার, ওষুধে ৮ হাজার ৫০, টি প্যাকেটিংয়ে সাড়ে ৮ হাজার, কটন টেক্সটাইলে ৫ হাজার ৭১০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে।

ট্যানারি, জাহাজভাঙা, ওষুধের মতো তুলনামূলক বড় খাত বিবেচনায় নিলে পোশাক খাতের মজুরি বেশ কম, ৫ হাজার ৩০০ টাকা। মালিকপক্ষ যে ১ হাজার ৬০ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে, সেটি বাস্তবায়িত হলেও কমই থাকবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমবিশেষজ্ঞ সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পোশাকশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব মালিকপক্ষ দিয়েছে, সেটি নৈতিক কিংবা আইনি—কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবে শ্রমিকদের সত্যিকার চাহিদার প্রতিফলন হয়নি। তাই নিম্নতম মজুরি বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্যের উচিত শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় হিসাব করে নতুন আরেকটি প্রস্তাব দেওয়া।’

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, নিম্নতম মজুরি বোর্ড গত কয়েক বছরে একেক খাতের জন্য একেক রকম মজুরি নির্ধারণ করেছে। এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। শ্রমিকদের ন্যূনতম চাহিদা প্রায় একই। জাহাজভাঙার মতো ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে শ্রমিকদের জন্য আলাদা করে ঝুঁকিভাতা থাকতে পারে।

 প্রতিযোগী দেশের তুলনায় মজুরি কম

বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। আবার কম মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দ্বিতীয়। শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা সবচেয়ে কম মজুরি পান, মাসিক ৬৬ মার্কিন ডলার। তারপর বাংলাদেশে ৬৮ ডলার। শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে বেশি তুরস্কে, ৫১৭ ডলার।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে। সেই প্রতিবেদনে শীর্ষ ২০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশের শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি উল্লেখ ছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনে ন্যূনতম মজুরি ১৫৫ ডলার, ভিয়েতনামে ১০০, ভারতে ৭৮ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১২৮, পাকিস্তানে ৯৯ ডলার, ফিলিপাইনে ১৫০ ডলার।

 মালিকপক্ষের বক্তব্য

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্যানারি ও জাহাজভাঙা শিল্পে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। তাই সেখানে মজুরি বেশি। তা ছাড়া পোশাক খাত খুবই শ্রমঘন। ফলে সেখানে মজুরি কিছুটা কম হবে, সেটিই স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, গত সাড়ে চার বছরে ২৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের ব্যবসার খরচ ৮-১০ শতাংশ বেড়েছে। সে জন্যই ২০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

অপর প্রশ্নের জবাবে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও আমরা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছি। এখন শ্রমিকেরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে শ্রমিকেরা জীবন যাপন করছেন। তাঁরা কি না খেয়ে থাকছেন?’