সরকারি ব্যাংকে ফিরছে বড়রা

>
  • ব্যাংকে তারল্যসংকট
  • বড় অঙ্কের ঋণ দিতে পারছে না বেসরকারি ব্যাংক।
  • তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন-সুবিধা পেতে আবার সরকারি ব্যাংকে ঝুঁকছে।

বেসরকারি ব্যাংক কার্যক্রমে আসার আগে সরকারি ব্যাংকনির্ভর ছিলেন সবাই। বিশেষ করে যাঁরা গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে ব্যবসা শুরু করেন, তাঁদের জন্য সরকারি ব্যাংকই ছিল অর্থায়ন-সুবিধা পাওয়ার একমাত্র উৎস। কিন্তু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কবলে পড়ায় তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় করপোরেট গ্রুপগুলো।

এরই মধ্যে অর্থায়নের দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। তারা উৎকর্ষও দেখাতে থাকে। ফলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ব্যাংকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এখন তারল্যসংকট চলছে।

এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে আবার ফিরতে শুরু করেছে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো। কারণ, সরকারি চার ব্যাংকেই রয়েছে বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট উদ্বৃত্ত তারল্যের অর্ধেকের বেশি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোও নিজেদের দুর্নাম ঘোচাতে চায়।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০০ সালের পর থেকে ব্যবসায়ীরা অর্থায়নের জন্য বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন। এ সময় সরকারি ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাও ধরা পড়ে। তবে ২০১৬ সালের আগস্টে সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের পর পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়।

এসব ব্যাংক বড় ও ভালো শিল্পগোষ্ঠীগুলোকে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ঋণেও মনোযোগ বাড়িয়েছে। যেমন, তারা এখন আবাসন নির্মাণ ও এসএমই খাতে জোর দিচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের ঋণ দিতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও চুক্তি করেছে ব্যাংকগুলো।

জানা গেছে, গত দুই বছরে অগ্রণী ব্যাংক বেশ কিছু নতুন গ্রাহককে ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সিটি গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, আকিজ, বিএসআরএম, পিএইচপি, আফতাব, কেডিএস, প্রাইম, নিটল, র‍্যাংগস। এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছে ব্যাংকটি। এ ছাড়া সিঙ্গার, একমিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে ব্যাংকটি।

গত সপ্তাহে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে এটির এমডি মোহাম্মদ শামস উল ইসলামকে একমির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমান সিনহার সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা গেছে।

এ সময় মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের যত বড় ব্যবসায়ী, সবাই তো সরকারি ব্যাংকের ওপর ভর করেই এত বড় হয়েছেন। অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে যাঁরা ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। আমরা এসব গ্রাহক ও নতুন কিছু ভালো প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকে নিয়ে এসেছি। তাদের নতুন করে ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’

রূপালী ব্যাংকও গত দুই বছরে কয়েকটি ভালো প্রতিষ্ঠানকে গ্রাহক করতে পেরেছে। এ সময়ে ব্যাংকটি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে ২৫০ কোটি, আবুল খায়ের গ্রুপকে ২৫০ কোটি, নিটল মোটরসকে ৫০ কোটি, বিএসআরএম গ্রুপকে ২০০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দিয়েছে। এ ছাড়া আকিজ, নাসির ও নোমান গ্রুপকে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ভালো প্রতিষ্ঠান খুবই কম। এ জন্য শুরু থেকেই ব্যক্তিগতভাবে ও ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। দুই বছরে কিছু ভালো গ্রাহককে ব্যাংকে আনতে পেরেছি। এ কারণে ব্যাংকের অবস্থা আগের থেকে কিছুটা ভালো বলা যায়।’

এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম নিয়ে সমস্যায় পড়া জনতা ব্যাংকও পিছিয়ে নেই। ব্যাংকটি নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নাইস টেক্সটাইলকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দিয়েছে।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নোমান গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক হয়েছে। পুরোনো সমস্যা কাটিয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকে আনার চেষ্টা করছি আমরা।’

এদিকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংক চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়াতে। ব্যাংকটি ভালো গ্রাহকদের পাশাপাশি ছোট ছোট ঋণ দিয়েও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। চার জেলায় ১১ হাজার দুগ্ধ খামারিকে ঋণ দিতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করেছে ব্যাংকটি। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ প্রকল্প চালু করেছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ে ঋণ দিতে বেশ কিছু নতুন প্রকল্প চালু করেছে ব্যাংকটি।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছোট ছোট ঋণ দিয়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে সেবার আওতায় আনা। এ জন্য নতুন বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।’