দেশে ইন্টারনেট সেবার মান নিম্ন

বাংলাদেশে মোবাইল ফোন-সেবায় ব্যবহৃত বেতারতরঙ্গের দাম এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্য দেশের তুলনায় তিন গুণ বেশি। দাম বেশি হওয়ায় মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ খরচ করতে হয় তরঙ্গ কেনায়। এর ফলে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তারা যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে পারে না। মানসম্মত নেটওয়ার্কের অভাবে মোবাইল ইন্টারনেটের মান ও গতি নিম্নমানের হচ্ছে। এতে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকেরা।

বাংলাদেশে বেতারতরঙ্গের ব্যবহার ও টেলিযোগাযোগ-সেবার মান নিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর এক গবেষণায় এ সব কথা বলা হয়েছে। ‘উন্নয়নশীল দেশে তরঙ্গের দাম: অপেক্ষাকৃত উন্নত মান ও সাশ্রয়ী মোবাইল সেবা পেতে করণীয়’ শীর্ষক এ গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে জিএসএমএ। এতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও উন্নত ৬০টি দেশের মোবাইল ফোন-সেবায় ব্যবহৃত তরঙ্গের ব্যবহার ও দাম নিয়ে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চতুর্থ প্রজন্মের (ফোর-জি) টেলিযোগাযোগ-সেবা চালু করার জন্য তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এতে তিনটি ব্র্যান্ডের মোট ৪৬ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশ বা ১৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বিক্রি হয়। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ তরঙ্গ বিক্রি না হওয়ার মূল কারণ উচ্চ মূল্য। বিভিন্ন দেশের তরঙ্গের দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশে যে দামে তরঙ্গ বিক্রি হয়েছে, বাংলাদেশে তা বিক্রি হয়েছে তিন গুণ বেশি দামে। মাথাপিছু জিডিপির মূল্যে তরঙ্গের এ দাম হিসাব করা হয়েছে।

>
  • জিএসএমএর গবেষণা
  • বেতারতরঙ্গের দাম প্রতিবেশীদের চেয়ে দেশে ৩ গুণ বেশি।
  • মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কের চেয়ে তরঙ্গ কিনতে বেশি বিনিয়োগ করতে হয়।

জিএসএমএর গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, তরঙ্গের বেশি দামের কারণে ফোর-জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্য দেশে ফোর-জি নেটওয়ার্ক যতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে, বাংলাদেশে তার ৫ ভাগের ১ ভাগও নেই। বাংলাদেশের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ৭১ শতাংশ এখনো এসব কারণেই টু-জি সংযোগ ব্যবহার করেন। প্রতি পাঁচজনে মাত্র একজন এখন মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।

এসব কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।

বিটিআরসির হিসাবে বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ১৩৩ মেগাহার্টজ তরঙ্গ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের জন্য মোট ৩০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ আছে। বেশি দামের কারণে তরঙ্গ বিক্রি না হওয়ার প্রসঙ্গে গবেষণায় বলা হয়েছে, অবিক্রীত থাকায় তরঙ্গের মতো একটি সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ, দাম কম হলে আরও বেশি তরঙ্গ বিক্রি হতে পারত, এতে সরকারের সার্বিক আয় বৃদ্ধি পেত। গ্রাহকের উন্নত মানের সেবাপ্রাপ্তিও নিশ্চিত হতে পারত।

উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে তরঙ্গের নিলাম মূল্য গড়ে পাঁচ গুণ বেশি বলে জিএসএমএর গবেষণায় বলা হয়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার চেয়ে অনেক সময় নগদ প্রাপ্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে উন্নয়নশীল দেশের সরকারের কাছে। এতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিনিয়োগ করে খরচ তুলে আনার বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এতে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে তারা কম খরচ করে। বিনিয়োগ তুলে আনতে সেবার দাম বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া মোবাইল ফোন অপারেটরদের হাতে তখন আর কোনো বিকল্প থাকে না। তরঙ্গের উচ্চ মূল্য মুঠোফোনের বাজার সম্প্রসারণকেই শুধু বাধাগ্রস্ত করে না, এটি একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। মুঠোফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। নগদ প্রাপ্তির চেয়ে সরকারের এ বিষয়ে আগে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করে জিএসএমএ।

এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের প্রধান করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে মোবাইল বেতারতরঙ্গের দাম সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম। তাই বেতারতরঙ্গে বেশি বিনিয়োগ করে মানসম্মত সেবা দেওয়া এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তরঙ্গের দাম কমলে গ্রাহকেরা একদিকে যেমন কম মূল্যে ইন্টারনেট সেবা পাবেন, অন্যদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে।