দাম আটকেও কাটছে না সংকট

>
  • দাম বাড়তে থাকায় ২৮ জুন ডলারের বিনিময়মূল্য স্থির করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক
  • ডলারের দাম ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সার বেশি বাড়তে দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক
  • চলমান ডলার-সংকটে বড় সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন

বিনিময়মূল্য বেঁধে দেওয়ার পরও ডলারের সংকট কাটছে না। সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমদানির ঋণপত্র খোলায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ডলার সংগ্রহে তারা দেশে-বিদেশে মনোযোগ বাড়িয়েছে। শুধু বেসরকারি ব্যাংক নয়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও পড়েছে একই সমস্যায়।

চলমান ডলার-সংকটে বড় সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ সংস্থাটি আগে সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংকের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি করত। এখন বিপিসির ঋণপত্র খুলছে শুধুই অগ্রণী ব্যাংক। বাকি ব্যাংকগুলোর কেউ চিঠি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কেউ মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে বিপিসির ঋণপত্র খোলা হবে না। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী, ফলে আমদানি খরচও বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া এক চিঠিতে এমন পরিস্থিতি তুলে ধরে বিপিসির চেয়ারম্যান আকরাম আল হোসেন লিখেছেন, জ্বালানি তেল আমদানির চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে যথাসময়ে ঋণপত্র খোলা একান্ত প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

দাম বাড়তে থাকায় গত ২৮ জুন প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা মৌখিকভাবে স্থির করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আর তা বাড়তে দেওয়া হয়নি। এতে বৈদেশিক ব্যবসায় লোকসানও গুনছে অনেক ব্যাংক।

এদিকে বাজারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে গত প্রায় দেড় মাসে ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিক্রি করেছিল ২৩১ কোটি ডলার। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ২২০ কোটি ডলার।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি অনেক বেড়েছে। যেভাবে টাকার অবমূল্যায়ন (ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া) শুরু হয়েছিল, তাতে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যেত। ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে। যদিও ডলারের দাম বাড়লে তা রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের জন্য ভালো। মির্জ্জা আজিজের পরামর্শ, সংকট কাটাতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে। কী আমদানি হচ্ছে সেদিকেও বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।

ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডলারসংকট তৈরির মূল কারণ হঠাৎ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। যে হারে আমদানি বেড়েছে, সে তুলনায় বাড়েনি রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে এ সময় রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ও প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এ কারণে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাড়তে শুরু করে ডলারের দাম। এতে চলতি বছরের শুরু থেকে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতি ডলারে দাম ছিল ৮০ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমানে তা কৃত্রিমভাবে ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সায় আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করছে। তাই ব্যাংকগুলোকে এ দামেই ঋণপত্রের দায় শোধ করতে হচ্ছে। যেসব ব্যাংকের প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কম, তারা বৈদেশিক ব্যবসায় মুনাফাই করতে পারছে না।

এর মধ্যে যেসব ব্যাংক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না করেই বেশি ঋণপত্র খুলেছে তাদের বিপদ আরও বেশি। বাজার থেকে বেশি দামে ডলার কিনে সেসব ব্যাংক ঋণপত্রের দায় শোধ করছে। চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক ইতিমধ্যে বাজার থেকে ৪ কোটি ডলার কিনেছে। এতে লোকসান গুনতে হয় ব্যাংকটিকে। তাই লোকসানে পড়েছে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকও।

এ অবস্থায় গত ২৬ জুলাই জনতা ব্যাংক এক চিঠিতে বিপিসিকে জানিয়েছে, ব্যাংকে ডলারের সংকট চলছে। বিপিসির দায় শোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার চেয়েও পাওয়া যায়নি। তাই বিপিসির যেসব ঋণপত্র খোলা হয়েছে, তা বাজারমূল্যে পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য বিপিসির লিখিত সম্মতি প্রয়োজন।

জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা, এ দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে অন্য ব্যাংক বা বাজার থেকে ৮৪ টাকার বেশি দামে ডলার কিনে দায় শোধ করতে হবে। এ জন্যই বিপিসির সম্মতি চাওয়া হয়েছে।

এদিকে বিপিসির চেয়ারম্যান চিঠিতে বলেছেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংকের পাশাপাশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংক এন এ, ওয়ান ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংকের মাধ্যমে বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানি করে আসছে। কিন্তু ডলার-সংকটের কারণে বেসরকারি ৬ ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে অপারগতা প্রকাশ করে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকও চিঠি দিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেছে। রূপালী ব্যাংক আগে প্রতি মাসে ৪-৫টি ঋণপত্র খুললেও এখন ১টি খুলছে। জ্বালানি নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিবেচনায় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে গভর্নরের কাছে।

বিপিসির পরিচালক (অর্থ) আলতাফ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংক ঋণপত্র খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র খুলে জ্বালানি তেল আমদানি করা হচ্ছে। এর ফলে জ্বালানি আমদানির উৎসগুলো সংকুচিত হয়ে এসেছে।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলার-সংকটের কারণে আমরা বিপিসির ঋণপত্র খোলা কমিয়ে দিয়েছি। যে পরিমাণ ডলার পাওয়া যাচ্ছে, সে অনুযায়ী ঋণপত্রের দায় তৈরি করা হচ্ছে, এর বেশি না।’

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হালিম চৌধুরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি বাড়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়েছে। এ ছাড়া অবৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় আসছিল। এখন এসব বন্ধ হয়েছে।

হালিম চৌধুরী বলেন, আকিজ গ্রুপ তাদের তামাক ব্যবসা জাপানের কাছে বিক্রি করল। এসব টাকা দেশে আসবে। বিদেশি সংস্থা থেকেও বেশ কিছু টাকা আসবে। রপ্তানি আদেশ বেশ বেড়েছে ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আসছে। এসবের যথাযথ ব্যবহার হলে রপ্তানি আয় বাড়বে। তবে ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ আসতে পারে।