বড় শিল্পে ভরপুর টঙ্গী বিসিক

টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকার একটি কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। সম্প্রতি তোলা ছবি।  প্রথম আলো
টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকার একটি কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা। সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

টঙ্গী বিসিক ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের চরিত্র বদলে গেছে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কারখানার পরিবর্তে এটি এখন গার্মেন্টস-পল্লিতে পরিণত হয়েছে। শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও এর আনুষঙ্গিক শিল্পকারখানায় ভরপুর টঙ্গী বিসিক এলাকা। বহুতল ভবনে এসব আধুনিক শিল্পকারখানা। এর ফলে টঙ্গী বিসিক সারা দেশের মধ্যে অন্যতম অনুসরণীয় বিসিকে পরিণত হয়েছে।

টঙ্গী বিসিক সূত্রে জানা গেছে, এই বিসিকে প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানাই বস্ত্র খাতের। বর্তমানে উৎপাদনরত ১৪৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৬টি হলো বস্ত্র ও এই খাতসংশ্লিষ্ট কারখানা। আর সব কটিই শতভাগ রপ্তানিমুখী। দেশের আর কোনো বিসিকেই অর্ধেকের বেশি বস্ত্র খাতের কারখানা নেই।

একাধিক কারখানার মালিক ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গ্যাস, বিদ্যুৎ-সংকটে ভুগছেন শিল্পমালিকেরা। গ্যাসের চাপ কম। সেই সঙ্গে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া তো আছেই। সম্প্রতি সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

১৯৬৪ সালে টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় এই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য পরিকল্পিতভাবে কারখানা তৈরির সুযোগ করে দেওয়া। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

টঙ্গী বিসিক প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে এই বিসিক আর ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রাজধানীর অদূরের টঙ্গী বিসিক এখন বড় শিল্পে ভরপুর। জানা গেছে, শুরুতে যাঁরা বিসিকে প্লট পেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেই প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে তৈরি পোশাক রপ্তানির চাহিদা বাড়ায় অনেক প্লট-মালিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বদলে বস্ত্র খাতের দিকে ঝোঁকেন। প্লটের মালিকানা ও শিল্পের চরিত্র বদলে যাওয়ায় গত দুই দশকে এখানে অনেক তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। ওভেন, নিট, ওয়াশিং, অ্যাকসেসরিজ কারখানা—কী নেই এখানে। টঙ্গী বিসিকে প্রত্যক্ষভাবে ৮০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।

>বর্তমানে বিসিকে উৎপাদনরত ১৪৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৬টিই বস্ত্র ও এই খাতসংশ্লিষ্ট কারখানা। বড় কারখানা হওয়ায় কর্মসংস্থানও বেশি।

বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ২১৪টি প্লটে এখন ১৬৩টি কারখানা আছে। অনেকেই কয়েকটি প্লট মিলিয়ে একটি কারখানা করেছেন। উৎপাদনে আছে ১৪৪টি কারখানা। উৎপাদনরত কারখানাগুলোর মধ্যে বস্ত্র খাতের কারখানা ৬৮টি। এ ছাড়া প্রিন্টিং ও পাবলিশিং কারখানা আছে ১৮টি। এর বেশির ভাগই তৈরি পোশাক কারখানার বিভিন্ন ধরনের লেবেল তৈরির জন্য। সেই হিসাবে বস্ত্র খাতেরই ৮৬টি কারখানা আছে। এ ছাড়া প্রকৌশল খাতের ২০টি কারখানা আছে, যেখানে ছোট ছোট যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। টঙ্গী বিসিক এলাকায় এখন ১০টি কারখানা নির্মাণাধীন আছে। এর মধ্যে আটটিই তৈরি পোশাক খাতের। এর মানে হলো, যাঁরা নতুন করে এই বিসিকে কারখানা তৈরি করছেন, তাঁদের সবার আগ্রহই বস্ত্র খাতে।

টঙ্গী বিসিকের শিল্পনগরী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্লটের মালিকানাও বদল হয়ে গেছে। বিএমআরই করে তৈরি পোশাকের মতো বড় শিল্প হয়েছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য বেশ ভালো। বিসিকের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, কর্মসংস্থান। তৈরি পোশাক খাতের কারখানা নির্মাণ হওয়ায় বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে।

বিসিকের নিয়ম অনুযায়ী, ভবন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতির খরচ ১৫ কোটি টাকা বা এর কমে হলেই ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু টঙ্গী বিসিকে এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এ বিষয়ে টঙ্গী বিসিকের এস্টেট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ছোট উদ্যোক্তারা একসময় বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক। এখন বড় বিনিয়োগকারী এখানে বিনিয়োগ করছেন, বেশি কর্মসংস্থান হচ্ছে।

গত ১২ আগস্ট সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো বিসিক এলাকা যেন একটি গার্মেন্টস-পল্লি। দেশের অন্য যেকোনো বিসিক থেকে এটির চিত্র একটু ভিন্ন। এখানকার প্রতিটি কারখানা ভবন পাঁচ-সাততলাবিশিষ্ট। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে শোনা যায় কারখানায় মেশিনের শব্দ। শ্রমিকেরা সবাই কাজে ব্যস্ত। বিসিকের প্রায় প্রতিটি সড়কেই আছে তৈরি পোশাক খাতের কারখানা।

একাধিক কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার কারখানাগুলো দ্বৈত কর, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-স্বল্পতায় ভুগছে। প্রতি প্লটের বিপরীতে কারখানার মালিকদের একবার বিসিককে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হয়। আবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনকেও প্লটপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা কর দিতে হয়। অন্যদিকে শিল্পকারখানায় যেমন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দরকার, তা পাওয়া যায় না। গ্রীষ্মে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। নতুন করে বিদ্যুৎ-সংযোগ যেমন দেওয়া হচ্ছে না, তেমনি বিদ্যুতের ক্ষমতা বৃদ্ধির (লোড বৃদ্ধি) আবেদন করেও সময়মতো সাড়া পাওয়া যায় না।

টঙ্গী বিসিকের সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন শেখ বলেন, এখনকার শিল্পে প্রয়োজনীয় গ্যাস পাওয়া যায় না। শুরুর দিকে বিসিকের অবস্থা মোটেও কারখানাবান্ধব ছিল না। রাস্তাঘাট ভালো না থাকায় কোনো মালামালের গাড়ি এ এলাকায় আসত না। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। পরে কারখানার মালিকেরা নিজস্ব অর্থায়নে রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ একটি শিল্পবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলে। এরপর থেকেই এখানে অনেক বড় কারখানা গড়ে ওঠে। এতে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।