তিন ফুটবল মাঠের সমান জাহাজ

বিদেশ থেকে আনা এই জাহাজ  ভেড়ানো হয়েছে সীতাকুণ্ড উপকূলে।  ছবি: সংগৃহীত
বিদেশ থেকে আনা এই জাহাজ ভেড়ানো হয়েছে সীতাকুণ্ড উপকূলে। ছবি: সংগৃহীত

জাহাজটি আয়তনে তিনটি ফুটবল মাঠের সমান। লম্বায়ও বিশাল, এক কিলোমিটারের তিন ভাগের এক ভাগ। একটি ৮৯ তলা উঁচু ভবন যতটা লম্বা, এটির দৈর্ঘ্যও ঠিক সেই রকম। দৈত্য আকৃতির এমনই একটি জাহাজ এখন বাংলাদেশের জলসীমায়।

পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে এত বড় জাহাজ আসার সুযোগ নেই। পণ্য বোঝাই করলে এই জাহাজের পানির নিচের অংশে থাকবে ২২ মিটার। এত গভীরতা নেই চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায়, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে। পণ্য না থাকার পরও এটির পানির নিচের অংশ এখন ৮ দশমিক ২ মিটার লম্বা। এই জাহাজ বাংলাদেশে কেন? যেহেতু জাহাজটি পণ্য নিয়ে আসেনি, তবে কী প্রদর্শনের জন্য আনা হয়েছে? সব প্রশ্নের উত্তর—না। আসলে জাহাজটি আনা হয়েছে ভাঙার জন্য। আর ভাঙা হবে সীতাকুণ্ডের উপকূলে এস এন করপোরেশন (ইউনিট-৩) ইয়ার্ডে।

জাহাজটির নাম ‘এমটি হেগায়া’। একসময় জাহাজটিকে পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এটির পণ্য পরিবহন ক্ষমতা ৩ লাখ ১০ হাজার ৫১৩ টন। এই জাহাজ লম্বায় ৩৩৪ দশমিক ৪৮৪ মিটার ও প্রস্থে ৫৮ দশমিক শূন্য ৮ মিটার। এর চেয়ে সামান্য ছোট আকারের আরেকটি জাহাজ গত মাসে আনা হয়েছিল। সীতাকুণ্ডের উপকূলে ভাঙার জন্য এর আগে যেসব বড় জাহাজ আনা হয়েছিল, সেগুলো সর্বোচ্চ ৩৩৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা ছিল। সেই হিসাবে এমটি হেগায়া হচ্ছে গত এক দশকে বাংলাদেশে আসা সবচেয়ে বড় জাহাজ।

জাহাজটির আয়তন কেমন, তা ফুটবল মাঠের সঙ্গে তুলনা করলে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। ফুটবল মাঠের আয়তন সর্বনিম্ন ৬ হাজার ৪০০ বর্গমিটার ও সর্বোচ্চ ৮ হাজার ২৫০ বর্গমিটার। তবে রাশিয়া বিশ্বকাপে প্রতিটি ফুটবল মাঠের আয়তন ছিল ৭ হাজার ১৪০ মিটার, যা আদর্শ মাঠের আয়তন হিসেবে আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন বা ফিফা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এমটি হেগায়া জাহাজের ডেক পাটাতনের আয়তন ১৯ হাজার ৪২৬ বর্গমিটার। সর্বনিম্ন বা আদর্শ ফুটবল মাঠের আয়তন তুলনা করলে এই জাহাজের আয়তন প্রায় তিনটি ফুটবল মাঠের সমান।

আয়তন তো গেল, লম্বায় কেমন হবে জাহাজটি? সেটিরও ধারণা পাওয়া যায় সুউচ্চ ভবনের সঙ্গে তুলনা করলে। বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ভবন সিটি সেন্টারের প্রায় দ্বিগুণ লম্বা এই জাহাজ। ১৭১ মিটার লম্বা ৩৭ তলাবিশিষ্ট ভবনটি ঢাকায় অবস্থিত। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বেজমেন্টসহ ২৪ তলার বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র (ডব্লিউটিসি) ভবনের সাড়ে তিন গুণের বেশি লম্বা জাহাজটি।

এই জাহাজ ছিল কুয়েত অয়েল ট্যাংকার কোম্পানির বহরে। পুরোনো হয়ে যাওয়ায় তারা জাহাজটি বিক্রি করে দেয়। হাতবদল হয়ে ২০ বছরের পুরোনো এই জাহাজের শেষ ঠিকানা হলো এখন চট্টগ্রাম। সীতাকুণ্ডের এস এন করপোরেশন শিপইয়ার্ড জাহাজটি কিনেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) কাদরি শিপ রিসাইক্লিয়ারস লিমিটেডের কাছ থেকে। কেনার পর কুয়েতের পরিবর্তে সেন্ট কিটস ও নেভিস দেশের নামে জাহাজটির নিবন্ধন সম্পন্ন করে ‘আল শেগায়া’ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘এমটি হেগায়া’। জাহাজটি কেনায় খরচ পড়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার সমান। এই ধরনের বড় জাহাজ এখন নির্মাণ করতে গেলে খরচ পড়বে ৬৫০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা।

>১৫০ কোটি টাকায় কেনা পুরোনো এই জাহাজ। এখন তার শেষ ঠিকানা সীতাকুণ্ডে। সেখানেই ভাঙা হবে।

এস এন করপোরেশন জানিয়েছে, জাহাজটি ভাঙার জন্য ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা অংশীদার তাসমিয়া আম্বেরীন। এই কোম্পানি হলো দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনী (২০১৩-১৪ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী) ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। তিনি বিদেশে থাকায় তাঁর মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।

চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা থেকে সীতাকুণ্ডের উপকূলে জাহাজটিকে শেষ ঠিকানায় নেওয়ার কাজটি করেছেন শিপ ব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী। জানতে চাইলে তিনি গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার জাহাজটি ভাঙার সুবিধার জন্য সীতাকুণ্ডের উপকূলে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বড় জাহাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে যেতে অন্তত ১৫ মিনিট সময় লাগে। ভাঙতে লাগবে অন্তত ছয় মাস। ২০১০ সালে ভারতের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ ‘নক নেভিস’ ভাঙতে সময় লেগেছিল এক বছর।

জানা যায়, জাহাজটিতে আছে ৩১ ধরনের পণ্য। এটি ভেঙে পাওয়া যাবে ৪২ হাজার ৪৪১ টন লোহা। সেই লোহার টুকরা বা প্লেট ব্যবহার করে তৈরি করা হবে রড। এই জাহাজের লোহা ব্যবহার করে যে রড পাওয়া যাবে, তা দিয়ে চট্টগ্রামের ২৪ তলাবিশিষ্ট বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের মতো ১২টি ভবন নির্মাণের রড পাওয়া যাবে।