আর্থিক খাতে সুযোগ বাড়ছে: আইএমএফ

হোসেন জিল্লুর রহমান ও এম এ মান্নান
হোসেন জিল্লুর রহমান ও এম এ মান্নান

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আম্বর শাহ মসজিদ মার্কেটে নাসিরউদ্দিন সবুজের দোকান। মোবাইলে ব্যালান্স দেওয়া ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা তাঁর। পাঁচ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। মূল ব্যবসা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের। এ মার্কেটে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এটিই প্রথম দোকান। এখন এই মার্কেটে তিনটি দোকান, পুরো বাজারে অনেকগুলো। প্রতিটি দোকান থেকেই বিকাশ, মোবিক্যাশ, রকেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং হয়। নাসির উদ্দিন সবুজ বললেন, ‘বাজারে এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনেক দোকান। দোকান যেমন বাড়তেছে, টাকা পাঠানোও বাড়তেছে।’

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে আর্থিক সেবায় মানুষের সুযোগ-সুবিধা বেশ খানিকটা বেড়েছে। আইএমএফের দ্য ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকসেস সার্ভেতে (এফএএস) এ চিত্র উঠে এসেছে।

অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে আইএমএফের তুলে ধরা উপাত্তে সেই চিত্র স্পষ্ট হয়েছে।’

গত শুক্রবার আইএমএফ এই জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাওয়া, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি, এটিএম বুথের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। জরিপে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি এক হাজার বর্গকিলোমিটারে বাণিজ্যিক ব্যাংক ২০১৩ সালে ছিল ৬৭টি। এটি ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭টিতে। এই পাঁচ বছরে প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৮ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৮টি।

২০১০ সালে দেশে ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলার কাজ শুরু হয়। মাত্র চার বছরের মধ্যে এই হিসাবের সংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি চলে আসে। ২০১৬ সাল থেকে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আর্থিক অনুদান ও ভাতা ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এর ফলে সাধারণ মানুষও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পেয়ে যায়।

এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন বয়স্ক ও বিধবা, মাতৃত্বকালীন, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৬৮ লাখ উপকারভোগী সরকারের কাছ থেকে সরাসরি নির্ধারিত অঙ্কের আর্থিক সুবিধা পায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অ্যাকাউন্টের পরিমাণ পাঁচ বছরে ব্যাপক বেড়েছে। ২০১৩ সালে প্রতি হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ব্যাংক হিসাব ছিল ৫৯৯টি। ২০১৭ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭০টি। এই সময়ে মোবাইল মানি এজেন্টদের সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। প্রতি লাখ মানুষরে জন্য ১৮৬ জন এজেন্ট ছিল। ২০১৭ সালে এর সংখ্যা হয়েছে ৬৬৬।

বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা গ্রহীতাদের হিসাব তৈরির ফলেই ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, এই হিসাব বেড়ে যাওয়া ইতিবাচক দিক। এর ফলে মানুষের অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। কিন্তু এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে, এমনটা মনে করার কারণ নেই।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর মনে করেন, হিসাব খোলা হয়েছে মূলত অর্থ পাঠানোর প্রয়োজনে। অর্থাৎ দাতার ইচ্ছাতেই এটি হয়েছে। যার হিসাব, তিনি শুধু গ্রহীতা। কিন্তু এই গ্রহীতাই যখন ঋণ বা অন্য কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কাজে যাবেন, সেখানে হয়তো তার সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি।

তবে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুরের সঙ্গে দ্বিমত করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, যে প্রান্তিক মানুষের কোনো হিসাবই ছিল না, তাকে একটি হিসাব খুলে দেওয়া মানে একটি বড় অগ্রগতি। বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষকে এভাবে আর্থিক সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এটি ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ। আবদুল মান্নান বলেন, ‘ক্ষমতায়ন মানুষের আয়, শিক্ষা ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এ পথে আমরা আছি। তবে এর জন্য সময় লাগবে।’

আইএমএফের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) বুথের সংখ্যা পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য আগে ছিল ৪ টি বুথ। এখন বুথের সংখ্যা ৮।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশগুলোর অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি। তবে একসময়ের দারিদ্র্যপীড়িত এসব দেশের মতোই বিশ্বের কয়েকটি দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব হয়ে গেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া মিয়ানমার ও গায়ানার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে মোবাইলে টাকা পাঠানোর পরিমাণও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। ২০১৩ সালে প্রতি হাজার জনে লেনদেন হতো ২ হাজার টাকা, গত বছর এটি ১৫ হাজার টাকার বেশি হয়েছে।