জনতা ব্যাংকের দুই পরিচালক অপসারণ

বড় অনিয়মের কারণে আলোচনায় থাকা জনতা ব্যাংকের দুই পরিচালককে অপসারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে একজন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মানিক চন্দ্র দে ও অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল হক। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকেই তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

গত বুধবার তাঁদের অপসারণ করে সরকার। সেদিনই জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তা অনুমোদন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে অনুমোদন দেয়। জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় যোগ নিতে গত বুধবার তাঁরা ব্যাংকে গেলেও অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। ফলে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের আকার কমে হলো ৮। যদিও পর্ষদে ১৩ জন পরিচালক থাকার কথা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিষয়ে গত বুধবার জনতা ব্যাংক অনুমোদন চেয়েছিল। সেদিনই এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

ব্যাংকটির একাধিক সূত্র জানায়, ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তাঁদের দুজনের তদবিরের কারণে বিরক্ত ছিলেন। এ ছাড়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব তৈরি হয়। বিশেষ করে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি ও টাকা পাচারের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে গিয়ে তাঁদের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিষয়টি ব্যাংকের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে সরকারকে জানানো হলে গত বুধবার তড়িঘড়ি তাঁদের সরিয়ে নেওয়া হয়। সেদিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে তাঁদের অপসারণের বিষয়টি জানানো হয়। তাঁদের দুজনকে গতকাল ফোনে পাওয়া যায়নি। আর জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা এসেছিল, ব্যাংক তা নিয়ম মেনে পরিপালন করেছে। এতে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছে।

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহা। পরিচালক হিসেবে আছেন সাবেক এমডি মোফাজ্জল হোসেন, ডিএমডি খন্দকার সাবেরা ইসলাম, হিসাববিদ মসিহ মালিক চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ কে ফজলুল আহাদ ও মোহাম্মদ আবুল কাশেম, নারী ব্যবসায়ী নেত্রী সেলিমা আহমদ।

সূত্র জানায়, বড় ধরনের অনিয়মের কারণে জনতা ব্যাংক এখন বেশ আলোচনায়। বিশেষ করে এননটেক্স গ্রুপের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ব্যাংকটি বড় সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। টাকা আদায়ে গ্রুপটির কর্ণধার এম এ কাদের ও আবদুল আজিজের সম্পদ নিলামে তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়মের কারণে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় গত জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় গত জুন শেষে ব্যাংকটির লোকসান হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই জনতা ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ হয়েছে। এ কারণে অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের ঋণ পেয়েছে। অন্য ব্যাংক থেকে খারাপ হওয়া ঋণ কেনা হয়েছে। এর বড় একটি অংশই এখন ফেরত আসছে না।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান লুনা শামসুদ্দোহাকে ফোন করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকটির তারল্যসংকট নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দেন জনতা ব্যাংকের এমডি। ওই চিঠিতে বলা আছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে তাঁদের ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা আমানত কমেছে। এতে তারল্যসংকট বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। গত ২৬ আগস্ট ২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা ধার করে ব্যাংকটি। তবে বর্তমানে তারল্য পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হয়েছে।