বেক্সিমকোর জন্য অগ্রণী ব্যাংকের বড় ছাড়

>
  • শেয়ারের দায় সমন্বয়
  • ৩০০ কোটি টাকা দিলেই বেক্সিমকোর ৫৩০ কোটি টাকার দায় সমন্বয় হবে।
  • এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।

ব্যাংক খাতে আবার ছাড় পাচ্ছে বেক্সিমকো গ্রুপ। এবার গ্রুপটির হাতে থাকা তিন কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে দেওয়া ঋণ সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এর ফলে খেলাপির খাতা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে বেক্সিমকো গ্রুপ।

অগ্রণী ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩০০ কোটি টাকা দিলেই বেক্সিমকোর দায় সমন্বয় করে দেওয়া হবে। অথচ বেক্সিমকোকে ব্যাংকটি যে ঋণসুবিধা দিয়েছিল, তা সুদাসলে দাঁড়িয়েছে ৫৩০ কোটি টাকায়। এখন এসে বেক্সিমকোকে ২৩০ কোটি টাকা ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সামনে নির্বাচন, গ্রুপটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে পারেন। এ কারণেই তড়িঘড়ি করে খেলাপিমুক্ত হতে চাইছেন। আশা করব, অগ্রণী ব্যাংক সেই সুযোগ দেবে না।

যেভাবে ছাড়

জানা গেছে, বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেডের নিশ্চয়তায় বা গ্যারান্টিতে ২০১১ সালে তিন প্রতিষ্ঠানের কাগুজে শেয়ারে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অগ্রণী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো বেক্সটেক্স, ইউনিক হোটেল ও জিএমজি এয়ারলাইনস। মূলত কোম্পানি তিনটির শেয়ারের বিপরীতে এই ঋণ নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে জিএমজি এয়ারলাইনসকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি বেক্সিমকো গ্রুপ। অপর দুই কোম্পানি বেক্সটেক্স ও ইউনিক হোটেলের প্লেসমেন্ট শেয়ারের বিপরীতে ঋণ দিলেও ওই শেয়ারের মালিকানা কাগজে-কলমে ব্যাংকের হয়নি।

৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপ সুদের ১০৭ কোটি টাকা শোধ করে। এর বাইরে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সুদসহ এই ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫৩০ কোটি টাকায়। এ পাওনা টাকার বিপরীতে জামানত হিসেবে বেক্সিমকো লিমিটেডের ১ কোটি ৫৩ লাখ ৮০ হাজার ও শাইনপুকুর সিরামিকসের ৯৯ লাখ শেয়ার অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে, যার বাজারমূল্য মাত্র ৫৪ কোটি টাকা।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের চাপেই অগ্রণী ব্যাংক কোম্পানিটিকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণসুবিধা দিয়েছিল। সালমান এফ রহমান বর্তমানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা।

এদিকে অগ্রণী ব্যাংক ছাড়াও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে প্লেসমেন্টে জিএমজির শেয়ার বিক্রি করে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু শেয়ারবাজারে কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত না হওয়ায় প্লেসমেন্টে বিনিয়োগের সিংহভাগ অর্থই ফেরত পাননি বিনিয়োগকারীরা।

বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ সমন্বয়ে বড় ধরনের ছাড় দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে বিনিয়োগ করা হয়েছিল, তা প্রায় কাগজ হয়ে গেছে। এ জন্য ব্যাংক আসল বিনিয়োগ ফেরত পেলেই আপাতত খুশি। গ্রাহক আশ্বাস দিয়েছে, এ টাকা ফেরত দিয়ে দায় সমন্বয় করবে।’

বাই ব্যাক চুক্তিতে বিনিয়োগ

বেক্সিমকোকে দেওয়া অগ্রণী ব্যাংকের ঋণসুবিধা-সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেডের করপোরেট গ্যারান্টিতে বেক্সটেক্স, ইউনিক হোটেল ও জিএমজি এয়ারলাইনসের শেয়ারের বিপরীতে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘সেল অ্যান্ড বাই ব্যাক অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর আওতায় ২০১০ ও ২০১১ সালে এ টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে বেক্সটেক্স লিমিটেডের জন্য ১০৮ কোটি টাকা, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের জন্য ১২৫ কোটি টাকা ও জিএমজি এয়ারলাইনসের জন্য ৬৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়।

উল্লিখিত তিন কোম্পানির মধ্যে ইউনিক হোটেলের একটি বড় অংশের শেয়ার প্লেসমেন্টে বেক্সিমকো গ্রুপ নিয়েছিল। বাকি দুটি কোম্পানির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সালমান এফ রহমান ও বেক্সিমকো গ্রুপ। এর মধ্যে বেক্সটেক্স আগে আলাদা থাকলেও ২০১১ সালে বেক্সিমকোর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। আর জিএমজি এয়ারলাইনস বর্তমানে নামসর্বস্ব একটি কোম্পানি। ২০১২ সালের ৩০ মার্চ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় জিএমজি এয়ারলাইনস।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বেক্সিমকো গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের হয়ে লিখিত বক্তব্য দেয় গ্রুপটির পক্ষে নিযুক্ত জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ইমপ্যাক্ট পিআর। তাতে বলা হয়, বেক্সটেক্স, জিএমজি ও ইউনিক হোটেলের শেয়ারে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অগ্রণী ব্যাংক। সেল অ্যান্ড বাই ব্যাক চুক্তির আওতায় এ বিনিয়োগ করা হয়, বর্তমানে সুদাসলে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩০ কোটি টাকা। যখন বিনিয়োগ করা হয়, তারপর শেয়ারবাজারে বড় ধসের কারণে শেয়ারের দাম অতি দ্রুত কমে যায়। এরপরও বেক্সিমকো গ্রুপ ১০৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বেক্সিমকো প্রকৃত বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ করতে চায়।

সময় ফুরালেও চুক্তি অকার্যকর

যে বাই ব্যাক চুক্তির আওতায় অগ্রণী ব্যাংক তিন কোম্পানির শেয়ার কিনেছিল, সেই বাই ব্যাক পদ্ধতি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর যে কোম্পানির কাছ থেকে শেয়ার কেনা হয়, সেই কোম্পানির বিক্রীত শেয়ার পুনরায় কিনে নেওয়ার কথা। এ সময় শেয়ার ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট হারে সুদ পাবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেডের করপোরেট গ্যারান্টিতে অগ্রণী ব্যাংকের কেনা শেয়ার নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, ক্রিসেন্ট ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, বেক্সিমকো হোল্ডিংস লিমিটেড, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেড ও ফার্মাটেক কেমিক্যালস লিমিটেডের পুনরায় কিনে নেওয়ার কথা। তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তীকালে অগ্রণী ব্যাংকের কাছ থেকে সেসব শেয়ার পুনরায় কিনে নেয়নি। এমনকি নির্ধারিত হারে সুদও পরিশোধ করেনি।

আলোচনার কেন্দ্রে

আর্থিক খাতে নানা অনিয়মের দায়ে বেক্সিমকো গ্রুপ তিন দশকের বেশি সময় ধরেই আলোচনার কেন্দ্রে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় বেক্সিমকো গ্রুপের নাম রয়েছে। ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত শোধ না করে নানাভাবে তফসিল সুবিধা নেওয়ার শীর্ষে বেক্সিমকো গ্রুপ। সম্পত্তি নিলামসহ নানা উপায়ে ঋণ আদায়ের চেষ্টা করেও কেনো ব্যাংক সফল হয়নি।

২০১৪ সালে সালমান এফ রহমানের দেওয়া প্রস্তাব মেনেই বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা’ করে। অজুহাত দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতাকে। এরপরই বেক্সিমকো গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকাসহ ১১টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়, যার বেশির ভাগই এখন ঋণ পরিশোধ করছে না।

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, যত দূর মনে পড়ে, জিএমজি এয়ারলাইনস কীভাবে টাকা মেরে দিয়েছিল, সেই তথ্য শেয়ারবাজার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসেছিল। এ গ্রুপটির সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের কারণে কেউ কিছু করতে পারে না। তারা অর্থশক্তি দিয়ে রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করতে পারে।