ব্যাংকের একজন পরিচালকও জবাবদিহির আওতায় নেই

বাকী খলীলী
বাকী খলীলী
ব্যাংক, বিমা ও পুঁজিবাজার-সবখানেই সুশাসনের বড় ঘাটতি। ফলে ব্যাংক খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ আর পুঁজিবাজারে ঘটছে নানা কারসাজির ঘটনা। এসব নিয়েই প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ব্যবসায় প্রশাসনের অধ্যাপক বাকী খলীলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম


প্রথম আলো:
দুই মেয়াদে ১০ বছর পার করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। কয়েক মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কেমন দেখছেন দেশের আর্থিক খাত?

বাকী খলীলী: ১০ বছর একটা লম্বা সময়। মোটা দাগে বলব, এই সময়েও আর্থিক খাতে সুশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়নি। না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সুশাসনের প্রবল ঘাটতি। আর এই ঘাটতির কারণ হচ্ছে আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর প্রধানদের মেরুদণ্ডহীনতা। নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রতিও তাঁদের অনেকের যেমন দায়বদ্ধতা নেই, আবার অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিক ক্ষমতা প্রয়োগেও তাঁদের ভীত থাকতে দেখা যায়।

প্রথম আলো: বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?

বাকী খলীলী: আর্থিক খাতের মধ্যে শুরুতে ব্যাংক খাত নিয়ে যদি বলি, কী দেখছি আমরা? এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি এখন খেলাপি ঋণ। ১০ বছরে পরিমাণটা আড়াই গুণ বেড়েছে। কারণটাও খুব স্বাভাবিক। এই সময়ে ব্যাংকগুলো দেদার উল্টোপাল্টা ঋণ দিয়েছে। টাকা ফেরত আসবে না জেনেও দিয়েছে। দেখা গেছে, অন্যের জমিকে নিজের বলে চালিয়ে একটি গোষ্ঠী সরকারি এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গেছে শত কোটি টাকা। টাকা উদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে গিয়ে ব্যাংক এখন দেখে যে জমির দলিলই নেই। ব্যাংকের কাছে তো দলিল নেই-ই, গ্রাহকের কাছেও নেই। অথচ ব্যাংক একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদ তাহলে কী করল? কার টাকা দিয়ে দিল? এতে নিশ্চিত অন্ধ রাজনীতিকরণ রয়েছে। আর অনুমান করতে পারি, এই টাকার অংশ কত জায়গায় গিয়ে থাকতে পারে।

প্রথম আলো: ব্যাংক খাতে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্তটি কীভাবে এসেছে দেখেছেন?

বাকী খলীলী: ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন এটিকে প্রথম সামনে আনে। এরপর একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত এল। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী দেখা গেল? কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনেক পরে জড়িত হতে দেখা গেছে। অথচ চাপিয়ে দেওয়া পদ্ধতির চেয়ে সুদের হার কমানোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই অনেক বিকল্প রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সুদের হার কমানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক রাজি হয়নি। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ট্রাম্পকে বুঝিয়েছে যে সুদের হার কমালে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে। ট্রাম্পও তা মেনে নেন। আসলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গভর্নর থাকলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে বোঝানোর ক্ষমতাও তাঁর থাকে।

প্রথম আলো: আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি সুচারুভাবে চলছে না?

বাকী খলীলী: আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা কার্যকরভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করুক। তাহলে ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো অনেকাংশেই কমে যাবে। তবে এখানে নজরদারির অভাবের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। আবার গোটা ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের অনুমোদন দিয়েছে, যেগুলোতে পরে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়েছে। একজন পরিচালককেও জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, তাঁরা তো সরকারি লোক। আবার অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করে আমরা তো শুধু নিয়োগ দিই, ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এই ফাঁকটি ব্যবহার করে পার পেয়ে যাচ্ছেন পরিচালকেরা।

প্রথম আলো: আর্থিক খাতের তো আরও দিক আছে...

বাকী খলীলী: আমি এখন বিমা খাত নিয়ে একটু বলতে চাই। এ খাত নিয়ে পুরোপুরি হতাশ। কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশও এ খাত ধারণ করে না। অথচ বাস্তবতা আছে, বিশাল সম্ভাবনাও আছে। একসময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বিমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) হয়েছে। এটিও ভালোভাবে চলতে পারছে না। সচেতনতার অভাব প্রকট। বিমা সম্পর্কে জানে মাত্র দেশের ১০ থেকে ১১ শতাংশ মানুষ। দাবি পরিশোধের পরিস্থিতিও করুণ, বিশেষ করে যারা গ্রামে আছে, তাদের দাবি পরিশোধ হতেই চায় না। বিমা কোম্পানির প্রতিনিধিরাও (এজেন্ট) কিন্তু দাবি পরিশোধের দায় নিতে পারেন না। কারণ, দাবি পরিশোধ তো হয় ঢাকা শহরে বসে। বিমা একাডেমিটাকে একটু শক্তিশালী করা গেলেও একটা কাজের কাজ হতো।

প্রথম আলো: অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন আগেই এক বক্তব্যে বললেন যে ধসের পর যেসব আইনকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে দেশে ভালো একটি পুঁজিবাজার গড়ে ওঠার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

বাকী খলীলী: পুঁজিবাজারটা ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ ঋণ-নির্ভরশীল। যে কারণে বারবার তারল্যের কথা আসে। সেকেন্ডারি বাজারে ব্যাংকই ঋণ দেবে, আমি এটা মনে করি না। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করতে হবে সঞ্চয় থেকে। ঋণ নিতে চাইলে সঞ্চয়ের বিপরীতে ঋণ নিতে হবে। উৎপাদনশীল খাত থেকে টাকা দিয়ে সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেনের জন্য টাকা দেওয়া হবে, এটা হওয়া উচিত না। আজকে ঋণ বন্ধ করে দিলে বাজার আরও নেমে যাবে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) প্রো-অ্যাকটিভ নয়। এত বছর হয়ে গেল তারপরও বিএসইসির বিশ্লেষণব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এ কারণে কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে এখনো নির্বিঘ্নে যেকোনো শেয়ারের দাম ওঠাতে-নামাতে পারে।