যাচ্ছে ডলার, আসছে বালু

বৈদেশিক বাণিজ্যে রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে বা আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের কৌশল অনেক পুরোনো। এখন এসে ঋণপত্রের পুরো টাকা যাতে বৈধ চ্যানেলে পাচার করা যায়, সে জন্য নতুন কৌশল নেওয়া হয়েছে। নতুন এ কৌশলে, পণ্য আমদানির বিপরীতে ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার পাঠানো বিদেশে কিন্তু নির্ধারিত পণ্যের বদলে আসছে মাটি, বালু, পানি। আবার কখনো কখনো আসছে ফাঁকা কনটেইনারও।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর আমদানি পণ্যের আড়ালে বালু-মাটি, পানিসহ মূল্যহীন পণ্য আনার তিনটি ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। এই তিন ঘটনায় পাচার হয়েছে প্রায় ৯৭ হাজার ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮১ লাখ টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৪ টাকা)। কাস্টমসের শনাক্ত হওয়া এ তিন ঘটনায় ৯৭ হাজার ডলার পাচারের তথ্য মিললেও ধারণা করা হচ্ছে, এ রকম বড় অনেক ঘটনা শনাক্তই করা যায়নি। এ তিনটি ঘটনার বাইরে গত তিন বছরে এ রকম আরও আটটি ঘটনা শনাক্ত করতে পেরেছে কাস্টমস। এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নজির পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যে ঘটনাগুলো ধরা পড়ছে, তা গুটিকয়েক। পাঁচ ভাগের বেশি হবে না। পারস্পরিক যোগসাজশের কারণে পঁচানব্বই ভাগই আড়ালে থেকে যায়। নির্ধারিত পণ্যের বদলে বালু-মাটি আনার অর্থ হলো, পুরো অর্থই পাচার করে দেওয়া। ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ ধরনের ঘটনাগুলো থামছে না।

কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, বন্দর দিয়ে কনটেইনারে বালু-মাটি পাঠানোর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে চীনের সঙ্গে। এর বাইরে সিঙ্গাপুরের একটি ঘটনা শনাক্ত করেছে কাস্টমস। বন্দর দিয়ে  অর্থ পাচারসংক্রান্ত একটি ঘটনা সর্বশেষ শনাক্ত হয় গত ১ সেপ্টেম্বর। এদিন এক কনটেইনার খুলে ৪১০ বস্তা বালু–মাটি পান কাস্টমস কর্মকর্তারা। অথচ কনটেইনারে থাকার কথা ছিল কাগজ। ঘটনা শনাক্ত হওয়ার আগেই ঢাকার বনানীর প্রোগ্রেস ইমপেক্স লিমিটেড ব্যাংকিং চ্যানেলে চীনের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ডালিয়ান রিশাংবো কমার্শিয়ালের কাছে সাড়ে ১৫ হাজার ডলার পাঠিয়ে দেয়। এই ঘটনায় গত ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার নুর উদ্দিন মিলনকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমদানিকারক প্রোগ্রেস ইমপেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ এম এ আকবর বলেন, চীনের রপ্তানিকারক তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাই পরিশোধ হওয়া অর্থ তিনি ফেরত আনতে আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

এর আগে গত ১৯ মে কাস্টমস কর্মকর্তারা বন্দরে চীন থেকে আসা একটি কনটেইনার খুলে এক ছটাক পণ্যও পাননি। অথচ এই কনটেইনারে ১১ হাজার ডলারের মাশরুম আনার কথা ছিল। এই পণ্য আমদানিকারক ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের কটনমার্ট ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় গিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা এটির অস্তিত্ব পাননি বলে জানান।

কাস্টমসের উপকমিশনার নুর উদ্দিন মিলন বলেন, এসব ঘটনায় মুদ্রা পাচার আইনে মামলা করার সুযোগ আছে। তদন্ত শেষে মুদ্রা পাচার আইনে মামলা করা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধের ঘটনার অনুসন্ধানে রাজস্ব বোর্ডের বিশেষায়িত সংস্থা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর রয়েছে। বছর দুয়েক আগেও সংস্থাটি বড় বড় ঘটনা শনাক্ত করলেও এখন এই সংস্থার বড় কোনো সাফল্য নেই।

মুদ্রা পাচার আইন থাকার পরও কেন এ–সংক্রান্ত মামলা হচ্ছে না জানতে চাইলে কাস্টমস কমিশনার এ কে এম নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মুদ্রা পাচার আইনে এত দিন মামলা করার এখতিয়ার ছিল না কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে। গত ৫ মার্চ রাজস্ব বোর্ড এক নির্দেশনায় জানিয়েছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এবং এর সংশোধনী ২০১৫ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার কাস্টম হাউসের রয়েছে। 

 আগের ঘটনার খবর নেই

এ বছর ছাড়া ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত কনটেইনারে মূল্যহীন পণ্য এনে পুরো অর্থ পাচারের অন্তত আটটি ঘটনা শনাক্ত করেছে কাস্টমস। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বন্দরে ২২টি কনটেইনার খুলে পাথর, সিমেন্ট ও বালু মিশ্রিত পাত উদ্ধার করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এসব কনটেইনারে চীন থেকে আমদানি করা ২ লাখ ৩৬ হাজার ডলারের ৪৭৩ টন ইস্পাতের পাত থাকার কথা ছিল। কাস্টমসের কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ কনটেইনারে ইস্পাতের পাত পাওয়া গেছে ৬৬ টন। বাকি ৪০৭ টন পাথর, সিমেন্ট ও বালু মিশ্রিত নকল পাত। এ হিসাবে প্রায় ৩৩ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। বাকি ২ লাখ ৩ হাজার ডলারের পণ্যই আমদানি হয়নি।

এর আগে ২০১৬ সালের আগস্টে চট্টগ্রামের লাকী ট্রেডিংয়ের ৪৩ কনটেইনার সরিষার একটি চালানে একই ঘটনা শনাক্ত করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এসব কনটেইনারে ১ হাজার টন সরিষা থাকার কথা থাকলেও কার্যত দশমিক ২ টন পাওয়া যায়। এর আগেই ব্যাংকিং চ্যানেল সিঙ্গাপুরের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটির কাছে সাড়ে ৩ কোটি টাকার সমান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো হয়।