বড় গন্তব্য হতে পারে রাশিয়া

>

• বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তসরকার কমিশন বৈঠক আজ মস্কোতে শুরু হবে।
• সেখানে বাণিজ্যের জটিলতা দূর করার বিষয়ে আলোচনা হবে।
• ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৬০ কোটি ডলার
• ২০২০ সালের মধ্যেই ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার
• বাংলাদেশ-রাশিয়া সরাসরি ব্যাংক লেনদেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশি পণ্যের বড় গন্তব্য হতে পারে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো। বর্তমানে দেশগুলো কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেট (সিআইএস) নামে পরিচিত। তবে সিআইএসভুক্ত বাজারটি জোরেশোরে ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। এ জন্য বাংলাদেশ সামান্য দায়ী হলেও প্রধানত দায়ী ওই দেশগুলোই। দেশগুলো এ ব্যাপারে রক্ষণশীল।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাসই পাওয়া গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৯১-৯৩ সময়ে যে ১১টি দেশ হয়, এগুলোকেই একসঙ্গে বলা হয় সিআইএস। দেশগুলো হচ্ছে রাশিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, আর্মেনিয়া, মালদোভা, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিআইএসভুক্ত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানিতে বড় সমস্যা হচ্ছে উচ্চ শুল্ক। শুল্কায়ন জটিলতাও আছে। তার চেয়েও বড় কথা দেশগুলোর সঙ্গে আধুনিক ব্যাংক যোগাযোগ নেই বাংলাদেশের। আবার বাণিজ্য করতে হয় তৃতীয় দেশের মাধ্যমে এবং মান্ধাতার আমলের টেলিগ্রাফিক লেনদেন (টিটি) পদ্ধতিতে। এসব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ এবং সিআইএসভুক্ত দেশগুলো। তার অংশ হিসেবে আজ সোমবার বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তসরকারের প্রথম বৈঠক রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে শুরু হচ্ছে।

তিন দিনব্যাপী এ বৈঠকে যোগ দিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ১৪ সদস্যের বাংলাদেশের একটি দল অংশ নিচ্ছে। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম। দলটিতে বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি রয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন সিআইএস-বিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. হাবীব উল্লাহ ডন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে (এডিবি) বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ বাণিজ্যসচিব থাকার সময় তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি দল ২০১৩ সালের অক্টোবরে রাশিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও ইউক্রেন সফর করে। তার ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি সহায়তা বিষয়ে ২০১৭ সালের ১ মার্চ গঠন করা হয় বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তসরকার কমিশন। অন্যদিকে কমিশনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতে গঠন করা হয় কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্টস স্টেট (সিআইএস)-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই), সংক্ষেপে যা সিআইএস-বিসিসিআই নামে পরিচিত।

 বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তসরকার কমিশনের প্রথম বৈঠকের আগে যে কার্যপত্র তৈরি করা হয়, তাতে দেখা যায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি ডলার, যা আগের বারের তুলনায় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য, যা আগের বারের চেয়ে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের আমদানি ৭৬ কোটি ২৯ লাখ ডলারের পণ্য, যা আগের বারের চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ কম। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সিআইএসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে রাশিয়ায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাশিয়ায় ৪৮ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। উজবেকিস্তানে রপ্তানি হয় প্রায় ৩ কোটি ডলার, ইউক্রেনে ২ কোটি ১৪ লাখ ডলার, আর্মেনিয়ায় ২৮ লাখ ৯২ হাজার ডলার ও বেলারুশে ২৭ লাখ ৪৮ হাজার ডলার মূল্যের পণ্য। এ ছাড়া মালদোভায় ২৩ লাখ ৫৬ হাজার, আজারবাইজানে ৭ লাখ ১৭ হাজার, তাজিকিস্তানে ৭ লাখ, কাজাখস্তানে ৬ লাখ, কিরগিজস্তানে ৩ লাখ এবং তুর্কমেনিস্তানে ২ লাখ ডলার দামের পণ্য রপ্তানি করা হয়।

বাংলাদেশ যে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি করছে, তা মূলত জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোর মাধ্যমে। এ কথা উল্লেখ করে কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে ৬ হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার জন্য পণ্য বহুমুখীকরণ যেমন দরকার, দরকার নতুন বাজারও। সিআইএস-ই হতে পারে সেই কাঙ্ক্ষিত বাজার। বাজারের আকার ২০২০ সালের মধ্যেই ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।

কার্যপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে রাশিয়া ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর বাইরে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) রয়েছে ১৮ শতাংশ। আবার বাংলাদেশ সরাসরি পণ্য রপ্তানিও করতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে পোল্যান্ড দিয়ে। অর্থাৎ পোল্যান্ডের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনে রাশিয়ায় রপ্তানি করেন। তবে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়ার বড় সুযোগ রয়েছে ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, আসবাব ইত্যাদি।

জানা গেছে, সিআইএসভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য না বাড়ার বড় সমস্যা হচ্ছে উভয় দেশের মধ্যে ব্যাংক লেনদেনের সুবিধা না থাকা। তবে রাশিয়ার ‘স্পুৎনিক’ নামক বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে আলোচনা হবে বৈঠকে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দিক থেকে প্রস্তাব করা হবে সোনালী ব্যাংকের নাম।

বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উভয় দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে আলোচনা ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বারের বৈঠকে ‘সিআইএস-বিসিসিআই ফোরাম’ নামে একটি ফোরাম তৈরি হতে পারে।

বৈঠকে যাওয়ার আগে গত বৃহস্পতিবার সিআইএস-বিসিসিআইয়ের সভাপতি হাবীব উল্লাহ ডন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বহুদিন থেকেই বলে আসছি যে সিআইএসভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশি পণ্যের সম্ভাব্য বড় বাজার। বিশেষ করে রাশিয়া। ঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এ বাজার থেকে চার গুণ রপ্তানি আয় করা সম্ভব আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই। আশা করছি এবারের বৈঠক থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের সুযোগটিও তৈরি হবে।’