বাণিজ্যযুদ্ধে শেষ বিচারে কেউ জেতে না, মানুষই শুধু হারে

  • হোসে ভিনালস স্পেনের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে ২৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন
  • ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে স্ট্যানচার্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন
  • ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) যোগ দেন
  • আর্থিক ইস্যুতে তিনি ছিলেন সংস্থাটির প্রধান মুখপাত্র
  • পেশা শুরু করেন অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হোসে ভিনালস
হোসে ভিনালস
সম্প্রতি চার দিনের সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্রুপ চেয়ারম্যান হোসে ভিনালস। এটি ছিল বাংলাদেশে তাঁর প্রথম সফর। সফরের শেষ দিনে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি পাঁচ তারা হোটেলে তিনি মুখোমুখি হন প্রথম আলোসহ দুটি ইংরেজি দৈনিকের। সেখানে কথা হয় বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের অর্থনীতি, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।


বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড (স্ট্যানচার্ট) ব্যাংকের গ্রুপ চেয়ারম্যান হোসে ভিনালস মনে করেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা এবং তা গতিশীল রাখতে হলে সবচেয়ে বেশি দরকার একটি শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা, বিচক্ষণ মুদ্রানীতি, আর্থিক সততা ও কাঠামোগত সংস্কার। এ চারটি ব্যবস্থা যে দেশে যত বেশি শক্তিশালী, সেই দেশের অর্থনীতি তত বেশি টেকসই ও দ্রুত প্রবৃদ্ধি হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

হোসে ভিনালস বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাজার। এ দেশের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসায়িক রীতি হলো এমনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা, যাতে এখানকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবসা করে। বাংলাদেশেও আমরা তাই করে থাকি, আমরা এ দেশকে আরও সমৃদ্ধিশালী করতে চাই।’

আলাপকালে স্ট্যানচার্টের চেয়ারম্যান কথা বলেন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে। এ প্রশ্নে হোসে ভিনালসের কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়। তিনি মনে করেন, যেভাবে চলছে, তাতে এটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এতে যুদ্ধে লিপ্ত দুই দেশের পাশাপাশি যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে আক্রান্ত হবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ চীনের সরবরাহ ব্যবস্থার অংশীদার দেশগুলোও। চূড়ান্ত বিচারে এ বাণিজ্যযুদ্ধ মোটেই পৃথিবীর জন্য ভালো খবর নয়। কারণ, এতে অনেক দেশই বাণিজ্যে সুরক্ষানীতির দিকে ঝুঁকতে পারে।

হোসে ভিনালসের মতে, বাণিজ্যযুদ্ধে শেষ বিচারে কেউ জেতে না। এ ধরনের যুদ্ধে মানুষ শুধু হারেই। আর বৈশ্বিক অর্থনীতির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি জানান, অনেক দেশেই বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এরই মধ্যে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে। যদিও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাণিজ্যযুদ্ধের নেতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি আছে কিছু সুবিধার দিকও। স্পেনের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমে গেলে সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়তে পারে। বাংলাদেশ তাতে লাভবান হতে পারে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণে চাহিদা কমলে তাতে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের চাহিদায়ও ভাটা পড়তে পারে।

বাণিজ্যযুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর ঘটবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে হোসে ভিনালস বলেন, হ্যাঁ, সে রকম সম্ভাবনা আছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, অন্যান্য দেশও এ সুযোগ নিতে পারে। যারা মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের আওতার বাইরে আছে, তারা এই সুযোগ নিতে পারে। তবে সেটি রাতারাতি ঘটবে না বলেই তাঁর মত। কারণ, এর জন্য একদিকে মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। এটা স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। এ জন্য সময় লাগবে।

এদিকে ইউরোপে আরেক প্রকৃতির সংকটের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। ব্রেক্সিটজনিত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি ইতালির ঋণসংকট ও ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া মার্চে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে তেলের দাম যেমন বাড়তে পারে, তেমনি কমতেও পারে।

বৈশ্বিক এ সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ। তবে সেটির বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে লাগবে যথাযথ সরকারি নীতি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা। এ জন্য কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি ও সম্পদ তৈরিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সেতুবন্ধ ঘটাচ্ছে বলে মত দেন তিনি। ভবিষ্যতেও স্ট্যানচার্ট এই কাজ করবে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। সে জন্য প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন হোসে ভিনালস। তিনি বলেন, আইনের শাসন, স্থিতিশীলতা, ভবিষ্যমুখিতা—এসব যে শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরই আকৃষ্ট করে তা নয়। এসব বিষয় নিশ্চিত করা গেলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও উপকৃত হবেন। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৭ তম। তিনি বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগ সূচকে উন্নতি করাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে রপ্তানি। সে জন্য রপ্তানি ব্যবস্থা যাতে ঠিকঠাক কাজ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বাইরে যাতে দ্রুত পণ্য পাঠানো সম্ভব হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য অবকাঠামো সবচেয়ে জরুরি বিষয়।

হোসে ভিনালস মনে করেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ এ দেশের মানুষ। এ দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও বিপুল। তাই এই জনসংখ্যাগত সুবিধা পেতে হলে মানুষকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে যে অর্জন, তা ঈর্ষণীয় বলে হোসে ভিনালস মনে করেন। এখন অর্থনীতির মৌলভিত্তি উন্নত করার সময় এসেছে। সে জন্য টেকসই ও দ্রুত প্রবৃদ্ধির জন্য যথোপযুক্ত নীতি প্রণয়ন করার ওপর জোর দেন ব্যাংকের এ নীতিনির্ধারক।