দিল্লির দূষণে ব্যবসার সম্ভাবনা সৃষ্টি

ভারতের রাজধানী দিল্লি ভয়ংকর বায়ুদূষণের শিকার। ছবি: রয়টার্স
ভারতের রাজধানী দিল্লি ভয়ংকর বায়ুদূষণের শিকার। ছবি: রয়টার্স
>

• বায়ুদূষণ মোকাবিলায় এগিয়ে আসছে একাধিক সংস্থা
• দূষণ প্রতিরোধে তৈরি করা নানা পণ্যের বাজার বাড়ছে
• ওষুধের দোকান থেকে অনলাইনে এসব পণ্যের বিক্রি বাড়ছে
• বায়ুদূষণ মোকাবিলায় জন্ম হচ্ছে ছোট ছোট উদ্ভাবনী শিল্পের

কথায় বলে, সংকট থেকেই নতুন সম্ভাবনার জন্ম হয়। ভারতের রাজধানী দিল্লির ভয়ংকর বায়ুদূষণ জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতার। দেশের বিদ্যুৎ-সংকট যেভাবে জন্ম দিয়েছিল জেনারেটর-ইনভার্টার শিল্পের, ঠিক সেভাবেই বায়ুদূষণ মোকাবিলায় এগিয়ে আসছে একাধিক সংস্থা। কোনোটি স্টার্টআপ, কোনোটি প্রতিষ্ঠিত সংস্থা। ফলে দেশে তৈরি হচ্ছে এক নতুন বাজার।

রাস্তাঘাটের দূষিত বাতাস রুখতে শুধু নাকঢাকা মুখোশ প্রথম চালু হয়েছিল ট্রাফিক পুলিশদের স্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদে। ক্রমেই সেই মুখোশ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। স্রেফ একটুকরো কাপড় দিয়ে নাকমুখ-ঢাকা মুখোশ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি দূষণ প্রতিরোধী মুখোশ। প্রতিদিন ১০ রুপির ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ মুখোশ থেকে শুরু করে ভারতে এখন দুই হাজার রুপির ‘ফিল্টার্ড এয়ার মাস্ক’-এর বাজার বাড়ছে। নামমুখ-ঢাকা মুখোশে যাদের অনীহা, তাদের জন্য বাজারজাত হয়েছে ‘ন্যাসাল ফিল্টার’। দিল্লি আইআইটির কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র ও তাঁদের অধ্যাপকেরা মিলেমিশে শুরু করেছেন এটি। মাত্র ২ সেন্টিমিটার মাপের এই ফিল্টার নাকের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক নিশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যায়। ক্ষুদ্র এই ফিল্টার বাতাসের ধূলিকণা আটকে দেয়। গত বছর ন্যাসাল ফিল্টারের উদ্ভাবকেরা রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছিলেন। সাধারণ মুখোশের মতো এই ফিল্টারও ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া যায়। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএমএ) অনুমোদনপ্রাপ্ত এই সব মুখোশ ও ধূলিকণারোধক ফিল্টার ওষুধের দোকান থেকে দেদার বিক্রি হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনেও।

ঘরের বাইরের দূষণের মতো বাড়ির অভ্যন্তরের দূষণরোধের বিষয়টিও প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সংস্থা অভ্যন্তরীণ ‘এয়ার পিউরিফায়ার’ বিপণন যেমন শুরু করেছে, তেমনই শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক প্রতিরোধের খোঁজ। পরিবেশবিদেরা ঘরের ভেতর বিভিন্ন ধরনের ‘ইনডোর প্ল্যান্ট’ রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন, যেগুলো বায়ুদূষণ প্রতিরোধক। বায়ুদূষণ ঠেকাতে কাঠকয়লার উপযোগিতা প্রভূত। ইতিমধ্যেই ছোট ছোট ব্যাগে ‘প্রক্রিয়াজাত কাঠকয়লা’ ঘরে রাখার চল শুরু হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত কাঠকয়লার এই ব্যাগ বাতাসে থাকা ধূলিকণা ‘পিএম ২ দশমিক ৫ ও ১০’ আলাদা করে ফেলে। বেঙ্গালুরুর একটি স্টার্টআপ বের করেছে একটি যন্ত্র, যা বাতাসের ধূলিকণা, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডি-অক্সাইড পৃথক করে দেয়। এই সংস্থা ঘরের বাইরের বাতাসও নির্মল করার যন্ত্র বের করেছে। গত অক্টোবর মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘হাফ ম্যারাথন’ অনুষ্ঠানে রাস্তায় এ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। সংস্থাটির দাবি, এই যন্ত্রের সাহায্যে দূষণ কমে প্রায় ৩৩ শতাংশ।

বিদ্যুৎ ঘাটতি রুখতে তৈরি হওয়া জেনারেটর বা ইনভার্টার শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এই শিল্পের বহর বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি রুপির। বায়ুদূষণের মোকাবিলায় যে শিল্প ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে, তার বাজারের বহর এখনো অজানা। শিল্প সংস্থা ‘ফিকি’ বা ‘সিআইআই’ এখনো এই বাজারের বহর ও তার সম্ভাবনা নির্ধারিত করতে পারেনি। ফিকির সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অঞ্জন রায়ের মতে, এর একটা কারণ, খুবই ছোট আকারে এই সব সম্ভাবনা মাথাচাড়া দিচ্ছে। তা ছাড়া জেনারেটর ও ইনভার্টার যেমন সারা বছর কাজে লাগে, দূষণ মোকাবিলার বিষয়টি তেমন নয়। তাই বাজারের মাপও এখনো নির্দিষ্ট করা যায়নি।

আসাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশে আর্সেনিকযুক্ত ভূগর্ভের পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করতে দারুণ কাজ হচ্ছে। স্থানীয় গবেষকেরা খুব সস্তায় এমন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যা দিয়ে ওই সব রাজ্যের মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ জন্য খরচ হচ্ছে লিটারপ্রতি মাত্র এক পয়সা। তামিলনাড়ুর কলেজ অধ্যাপক রাজাগোপালন বাসুদেবন রাস্তা তৈরিতে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের ব্যবহার শিখিয়েছেন। পাথরকুচির সঙ্গে গলিত প্লাস্টিক মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে রাস্তা। এক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরিতে। পৃথিবীর ৬০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য ভারতের।

বায়ুদূষণের মোকাবিলা ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে জন্ম দিচ্ছে ছোট ছোট উদ্ভাবনী শিল্প ও কর্মসংস্থানের। কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধিতে তাই দূষণ দেখাচ্ছে অন্য এক আলো।