তরুণদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

প্রথম আলো আয়োজিত ‘তারুণ্যের উদ্যোগ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বিডার নির্বাহী পরিচালক কাজী মো. আমিনুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর সিএ ভবনে প্রথম আলোর কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ‘তারুণ্যের উদ্যোগ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বিডার নির্বাহী পরিচালক কাজী মো. আমিনুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর সিএ ভবনে প্রথম আলোর কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব তরুণদের প্রথম আগ্রহ সরকারি চাকরির প্রতি। তাঁদের মধ্যে সরকারি চাকরি যাঁরা পাচ্ছেন না, তাঁরা বেসরকারি চাকরির জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছেন না। ফলে একপর্যায়ে গিয়ে না সরকারি, না বেসরকারি—কোনো চাকরিই মিলছে না। এতে এই তরুণেরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে তরুণদের বের করে আনতে হলে উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই।  এর জন্য তরুণদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। গতকাল প্রথম আলো আয়োজিত ‘তারুণ্যের উদ্যোগ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন।

উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সাংস্কৃতিক ও মানসিক পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হতে গেলে ভিন্ন প্রকৃতির ও খ্যাপাটে মানুষ হতে হয়। কিন্তু সমাজ মনে করে, ছোট মানুষের বেশি কথা বলা উচিত নয়। এই মানসিকতা উদ্যোক্তা তৈরির অনুকূল নয় বলে তিনি মত দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ভাষার মধ্যে কৈফিয়তের সুর থাকলে চলবে না। দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা চাকরি খোঁজার মানসিকতা তৈরি করছে।

বিডার কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, আগামী কয়েক বছরে দেশে তাঁরা এক লাখ উদ্যোক্তা তৈরি করতে চান। তাঁর মতে, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে উদ্যোক্তা তৈরির ওপর।

গোলটেবিল বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারছে না। এ ব্যাপারে তরুণ ও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাঁর পরামর্শ, অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আইন-কানুনের জটিলতার কারণে আটকে যাচ্ছেন। তাই এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি–সহায়তা দরকার।

গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, যেকোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ; তবে এটাই উদ্যোক্তা হওয়ার প্রধান শর্ত নয়। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য লাগে সাহস, উদ্যম, জেদ ও লেগে থাকার মানসিকতা। এসব থাকলে অর্থায়ন বর্তমান বাস্তবতায় খুব কঠিন বিষয় নয়। দেশের মানুষ, এমনকি অনেক উদ্যোক্তাও মনে করেন, ব্যাংকই অর্থায়নের প্রধান উৎস। এ প্রসঙ্গে বিডি ভেঞ্চার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত হোসেন বলেন, স্টার্টআপ কোম্পানির পক্ষে ব্যাংকের কাছে যাওয়া কঠিন। এ জন্য দরকার ইক্যুইটি বিনিয়োগ। কারণ, ব্যাংকঋণ নেওয়ার পরপরই ঋণ পরিশোধের তাড়া থাকে, যেটা নতুন উদ্যোগের জন্য খুবই সমস্যাজনক। তাই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল নতুন উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় সহায় হতে পারে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানও এ বিষয়ে একই কথা বলেন।

শওকত হোসেন বলেন, দেশের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল আইন হয়েছে ২০১৫ সালে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, তারপরও বিনিয়োগকারীরা এতে বিনিয়োগ করতে চান না। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। অন্যদিকে করপোরেট খাতের সঙ্গে এসএমই খাতের সংযোগ থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন। কারণ, দেশের বড় বড় করপোরেট খাত এসএমই খাতকে বড় হতে দিচ্ছে না বলে তাঁর অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে তিনি জাপানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে এসএমই খাতে প্রচুর নতুন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। তারা বড় করপোরেট খাতের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রাশেদুর রহমান বলেন, কোথায় দেশের সক্ষমতা, আর কোথায় দুর্বলতা—তা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। ১ হাজার নয়, আগামী কয়েক বছরে ১০০ জন ভালো উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারলেই যথেষ্ট। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিল্প খাতের সম্পর্ক নেই জানিয়ে তিনি পরামর্শ দেন, এই দূরত্ব ঘোচাতে শিল্প খাতকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর উদ্যোক্তা হতে গেলে শিক্ষা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সংমিশ্রণ থাকতে হবে।

আবার চাকরির ক্ষেত্রে শুধু দক্ষতা থাকলে চলবে না, নিয়োগকর্তার চাহিদা পূরণের মানসিকতা থাকতে হবে বলে মনে করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউর বিভাগের চেয়ারম্যান শিবলি শাহরিয়ার। তিনি বলেন,  নিয়োগদাতারা কর্মীদের মাঝে নেতৃত্বগুণ, উদ্যোগ ও রাজস্ব সংগ্রহে ভূমিকা রাখার মানসিকতা দেখতে চান। যাঁরা এসব গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন, চাকরি না করে তাঁরা উদ্যোক্তাও হতে পারবেন।

প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান বলেন, প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ দেশের কর্মবাজারে আসছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ তরুণ উদ্যোক্তা হলে দেশের চিত্র পাল্টে যাবে। উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক বাধা আছে, তিনি সেগুলো দূর করার আহ্বান জানান।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুল হাকিম, জুমলাভিত্তিক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান জুমশেপারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ, চট্টগ্রামভিত্তিক নতুন ঘরানার রেস্তোরাঁ বারকোড গ্রুপের উদ্যোক্তা মনজুরুল হক, এসএমই ফাউন্ডেশনের ২০১৮ সালের বর্ষসেরা মাঝারি উদ্যোক্তা এমএম প্লাস্টিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী তৌহিদুর রহমান, বাংলা ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিউটি পোর্টাল সাজগোজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিনথিয়া শারমিন ইসলাম ও গয়নার প্রতিষ্ঠান শৈলীর প্রধান নকশাকার-উদ্যোক্তা তাহমিনা শৈলী।