হঠাৎ মালিকানা বদল দুই বিমা কোম্পানির

>
  • নির্বাচনের ডামাডোলে নীরবে বদলে যাচ্ছে বিমা কোম্পানির মালিকানা
  • মালিকানার এই বদল নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেন না
  • বিমা খাতের পরিবর্তনের পেছনেও আগের ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠান জড়িত

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মালিকানায় ‘হঠাৎ’ বদলের পর এবারের বদলের পালা বিমা খাতে। এক দিন আগে-পরে জীবনবিমা খাতের দুটি কোম্পানিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কোম্পানি দুটি হলো ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এবং প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। দুটি কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং ইসলামি ধাঁচের জীবনবিমা কোম্পানি। কোম্পানি দুটির ১৪ জন পরিচালক সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন।

বিমা খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক খাতে মালিকানা পরিবর্তনের পেছনে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিলেন, বিমা খাতের পরিবর্তনেও তাঁরাই রয়েছেন। এর আগে গত মাসে পদ্মা ইসলামী লাইফের বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এরপর পরিবর্তন আসে ডেল্টা লাইফে। মনজুরুর রহমানের পরিবর্তে ডেল্টা লাইফের চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক সেনাপ্রধান এম নূরউদ্দিন খানকে।

তার আগে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির পর্ষদে একই পদ্ধতিতে হঠাৎ পরিবর্তন আনা হয়।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বিমা খাতের প্রধান নিয়ন্ত্রক হওয়া সত্ত্বেও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এসব পরিবর্তনের ব্যাপারে অন্ধকারে রয়েছে।

আইডিআরএ চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবর্তনের বিষয়গুলো কোম্পানির নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের কাছে ফারইস্ট বা প্রাইম লাইফের নতুন পরিচালকদের কিছু আসেনি।’

বিএসইসি মুখপাত্র সাইফুর রহমানও বলেন, তালিকাভুক্ত এ কোম্পানি দুটির পর্ষদ পরিবর্তনের কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই।

ফারইস্ট ও প্রাইম লাইফ—দুই কোম্পানিতেই পরিচালক হিসেবে রয়েছে সাইফ্যাং সিকিউরিটিজ, যার প্রতিনিধিত্ব করছেন নাসির বিন জালাল নামের একজন। সাইফ্যাং সিকিউরিটিজের অন্যতম পরিচালক এম কামাল উদ্দিন। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) পরিচালক হিসেবে সাইফ্যাং সিকিউরিটিজের নাম রয়েছে। এম কামাল উদ্দিন মার্কেন্টাইল লাইফ ইনস্যুরেন্সেরও চেয়ারম্যান। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ এসআইবিএলের মালিকানায় আসার পর ব্যাংকটিতে এম কামাল উদ্দিন পরিচালক হিসেবে আসেন।

মুঠোফোনে জানতে চাইলে গত রাতে এম কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি মজলিশে রয়েছেন এবং দুই থেকে তিন দিন পর এ ব্যাপারে কথা বলতে পারবেন।

 ফারইস্ট লাইফ

ফারইস্ট লাইফের পর্ষদ ২০ সদস্যের। এর মধ্যে গত ২২ অক্টোবর পদত্যাগ করেছেন ছয় পরিচালক। ছয়জনের মধ্যে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের বিদায়ী চেয়ারম্যান এম এ খালেকের পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্টই পাঁচজন।

ফারইস্ট লাইফের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত পর্ষদ বৈঠকে নতুন ছয় পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে একজন পরিচালক হলেন সাইফ্যাং সিকিউরিটিজের পরিচালক নাসির বিন জালাল।

ফারইস্টের পর্ষদে পরিবর্তন নিয়ে কয়েক মাস ধরেই প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তিন সপ্তাহ ধরে যোগাযোগ করা হচ্ছে চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহর সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা বরাবরই কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

সর্বশেষ গতকাল রোববার নজরুল ইসলামকে খুদে বার্তা দিয়ে ফারইস্ট ও প্রাইম লাইফে তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ব্যক্তিরা থাকলেও অন্যদের পদত্যাগ করতে হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্ন করা হয়। এরও কোনো জবাব দেননি তিনি।

তবে প্রধান কার্যালয়ে গতকাল এমডি হেমায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ছয়জন পদত্যাগ করেছেন, ছয়জন এসেছেন। এর বাইরে কোনো প্রশ্নের জবাব নেই তাঁর কাছে। যদিও চেয়ারম্যান অনুমতি দিলে তিনি সব বলতে পারবেন।

পদত্যাগকারীদের অন্যতম এম এ খালেকও গতকাল কোনো জবাব দেননি।

 প্রাইম লাইফ

দুই স্বতন্ত্রসহ প্রাইম লাইফের পর্ষদ ১৭ সদস্যের। প্রাইম লাইফের গত বুধবার অনুষ্ঠিত পর্ষদ বৈঠকে নতুন আট পরিচালকের নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। তার আগে গত ২৩ অক্টোবর পদত্যাগ করেন চেয়ারম্যানসহ প্রাইম লাইফের আট পরিচালক। প্রাইম লাইফের চেয়ারম্যানও ছিলেন এম এ খালেক।

পদত্যাগকারী পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান এম এ খালেক, যিনি ম্যাকসন বে লিমিটেডের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। এম এ খালেকের স্ত্রী পরিচালক সাবিহা খালেক এবং মেয়ে সারওয়াত খালেদও পদত্যাগ করেন।

কোম্পানিটিতে যাঁরা নতুন আসেন, তাঁরা হলেন গোমতী টেক্সটাইলের এমডি মো. আখতার, আইডিআরএর সাবেক সদস্য সাবেক জেলা জজ মো. ফজলুল করিম, মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান মজুমদার, এ টি এম এনায়েতুর রহমান এবং আরিফ হোসেন ওরফে রনি।

বাকি চারজন নোমান করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে নোমান হাসান ভূঁইয়া, এসবি করপোরেশন নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী নাজমুল হাসান ভূঁইয়া, সাইফ্যাং সিকিউরিটিজের প্রতিনিধিত্বকারী নাসির বিন জালাল এবং স্বতন্ত্র পরিচালক এ টি এম এনায়েতুর রহমান। আগে পরিচালক ছিলেন এবং এখনো আছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের আত্মীয়।

পরিচালক ওয়াহিদ মুরাদ জামিলের কাছে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, গত বুধবার স্বল্প সময়ের একটা সভায় নতুন পরিচালকেরা অনুমোদন পেয়েছেন। বিশদ কিছু জানেন না তিনি। আরেক পরিচালক অলক সাহা বলেন, তিনি বিদেশে ছিলেন, এই ফাঁকে পর্ষদ সভা হয়েছে। তাই কিছু জানেন না।

কী করে পরিচালক হলেন, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নতুন পরিচালক ফজলুল করিম বলেন, তিনি ব্যস্ত, পরে কথা বলবেন।

প্রাইম লাইফের নতুন চেয়ারম্যান মো. আখতার গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জোর করে কাউকে সরিয়ে দেওয়াটা বা নিজে থেকে সরে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করাটাও কাম্য নয়। আমার বরং একটা প্রশ্ন রয়েছে—ব্যাংক খাতে রাতারাতি যাঁরা এসেছিলেন, বিমা খাতেও কি তাঁরাই আসছেন? যদি তা-ই হয়, তাহলে তো বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমি মনে করি, পর্ষদে রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার বার্তাটি দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ।’