জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা ঠিক নয়

এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম
এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম
দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি, নির্বাচন, ব্যাংক খাতে সুশাসন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিতে হঠাৎ মালিকানা পরিবর্তনের প্রবণতা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম।


প্রথম আলো:
সামনে নির্বাচন। গরম হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। এই সময়ে দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: এখনো পর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক উদ্বেগের কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক চাপ তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করলে অবশ্য মিশ্র চিত্র দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের বড় ভূমিকা, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স)। রপ্তানি আয় চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৭ শতাংশ। ফলে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বেড়েছে। আবার প্রবাসী আয়ও এবার ১২ শতাংশ বেশি এসেছে, যা আগেরবার ছিল ৭ শতাংশের কম।
প্রথম আলো: তাহলে অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক কিছুই নেই?
মির্জ্জা আজিজ: নেতিবাচক ইঙ্গিত দেয়—এমন দিক অবশ্যই আছে। একটু আগেই বলেছি যে অর্থনীতিতে মিশ্র চিত্র দেখা যাচ্ছে। তার একটা হচ্ছে মুদ্রা বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন প্রবণতা। ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর ১ ডলারের মূল্যমান ছিল ৮১ টাকা ১৫ পয়সা। এ বছরের একই তারিখে তা দাঁড়িয়েছে ৮৩ টাকা ৮৮ পয়সা। বাজারে অবশ্য আরও বেশি আছে। এই ক্রমাগত অবমূল্যায়ন ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত পর্যায়ে ডলার ছাড়ছে, তাতে টান পড়ছে আবার রিজার্ভে। এক বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি রিজার্ভ কমে গেছে।
প্রথম আলো: ৩ হাজার ২০০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ডলার রিজার্ভ কমে যাওয়ার খুব প্রভাব কি আছে?
মির্জ্জা আজিজ: এখনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন হতে থাকলে ভবিষ্যতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। তবে সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হচ্ছে, কর-রাজস্ব আহরণের নিম্নহার। সম্প্রতি কর মেলা হয়েছে এবং বড় অঙ্কের টাকা সংগ্রহ হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ শতাংশ, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৩ শতাংশ।
প্রথম আলো: সামনে নির্বাচন বলেই কি রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি কম?
মির্জ্জা আজিজ: বলা মুশকিল। তবে কর সংগ্রহে সাধারণত যেসব পদক্ষেপ এনবিআর নিয়ে থাকে, নির্বাচন সামনে বলেই হয়তো সংস্থাটি সেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যাংক খাতের মন্দ বা কুঋণের পরিমাণ। এ বছরের মার্চে কুঋণ ছিল ৭২ হাজার কোটি টাকা। জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা এবং ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।
প্রথম আলো: ঋণখেলাপিরা তো আইনপ্রণেতাও হতে চান।
মির্জ্জা আজিজ: এর দুটো দিক আছে। একটা হচ্ছে যাঁরা ঋণ পুনঃ তফসিল বা পুনর্গঠনের আওতায় আসেননি, তাঁদের কেউ কেউ হয়তো নির্বাচনে অংশ নিতে ঋণ পরিশোধ করবেন। কারণ, নির্বাচন করতে গেলে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) ক্লিয়ারেন্সের দরকার হয়। তবে একটা চাপ আসবে যে ঋণ পরিশোধ না করেও যেন নির্বাচনে আসা যায়। আরেকটা হতে পারে যে নির্বাচনের খরচ মেটাতে এই সময়েও অনেকে ঋণ নেবেন। সেগুলোও কুঋণে পরিণত হতে পারে।
প্রথম আলো: আপনি ব্যাংক খাত নিয়েই বেশি বলছেন।
মির্জ্জা আজিজ: বলছি এ কারণে যে এ খাতটিতে সার্বিকভাবে সুশাসনের বড় অভাব। এই খাতের সুশাসনে নজর দেওয়া হচ্ছে না। বরং আমি বলব, কিছুটা অবনতি দেখা গেছে। সম্প্রতি যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, একই পরিবারের ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পর্ষদ সদস্য থাকতে পারবেন এবং ৬ বছরের পরিবর্তে থাকতে পারবেন তাঁরা নয় বছর, এগুলো ব্যাংক খাতের সুশাসনের জন্য স্বস্তিকর নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ব্যাপারে শক্ত থাকা উচিত ছিল।
প্রথম আলো: রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কি কিছু করার থাকে?
মির্জ্জা আজিজ: থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে আইন আছে, তাতে এমন কিছু দেখা যায় না, সরকার নির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে সরকার যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে নির্দেশনা দিচ্ছে বা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
প্রথম আলো: নতুন ব্যাংকের লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতে ‘না’ করেও পরে আবার লাইসেন্স দিয়ে দেয়।
মির্জ্জা আজিজ: আমি এই আলোচনায় আসছি। আগে যে নয়টা ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আপত্তি ছিল বলেই জানা গেছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছিলেন দেওয়া হবে না। পরে আবার তিনিই বললেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আরও তো তিনটা দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আমি বলব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নিজস্ব ক্ষমতা আছে, তার শক্তিশালী ব্যবহার হচ্ছে না।
প্রথম আলো: অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কীভাবে চলে? রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মেনে নিয়েই?
মির্জ্জা আজিজ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকও যেহেতু একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তো থাকবেই। সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা সম্পর্ক বা কাজের সমন্বয় থাকার কথা। কিন্তু তার মানে এই না, যে সিদ্ধান্তগুলো অর্থনীতির বিচারে কাঙ্ক্ষিত নয়, শুধু রাজনৈতিক কারণে সেসব সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যথার্থ। একটি উদাহরণ দিই, কিছুদিন আগে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর জনসমক্ষে সরকারের ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছেন। মোদি সরকার চাচ্ছে ঋণ বিতরণের বিধি শিথিল করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে রাজি হয়নি। এটা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। তিনটি কমিটি হয়েছে, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও প্রতিনিধি আছে। পরে কী হবে জানি না, কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা অবস্থান তো নিয়েছে। যেটা আমাদের দেশে কখনোই দেখা যায় না।
প্রথম আলো: এখানে তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবস্থান নেয় না। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, বিমা খাতের বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষসহ (আইডিআরএ) প্রায় সব নিয়ন্ত্রক সংস্থারই একই দশা।
মির্জ্জা আজিজ: এটার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) যে কমানো হলো, তা–ও কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব সিদ্ধান্তে নয়। আবার যে সময়ে কমানো হলো, সে সময় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম ছিল না। মুদ্রানীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তার চেয়ে বরং বেশিই ছিল। তা সত্ত্বেও যেভাবে এবং যে প্রক্রিয়ায় কাজটি করা হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে তা প্রত্যাশিত নয়।
প্রথম আলো: নির্বাচন সামনে রেখে কয়েক হাজার কোটি টাকা দিয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হচ্ছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই। কীভাবে সম্ভব?
মির্জ্জা আজিজ: মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন তো লাগার কথা। দরপত্র ছাড়াই কি কিনছে?
প্রথম আলো: সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে। নির্বাচন কমিশন সচিব যে বললেন ক্রয় কমিটিতে যেতে হবে না। যেহেতু সরকারের একটি দপ্তর থেকে আরেকটি দপ্তর তা কিনবে।
মির্জ্জা আজিজ: বিক্রি করবে কে, আর কিনবে কে? টাকা দেবে কে? যে টাকা দেবে সে কি ক্রেতা? যদি বলি বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) বিক্রি করবে, তাহলে বিএমটিএফ কি কখনো ইভিএম উৎপাদন করেছে, না এই জাতীয় পণ্য সরবরাহ করেছে? এই প্রশ্নগুলো এসে যায়।
প্রথম আলো: ব্যাংক খাতে হঠাৎ হঠাৎ মালিকানা বদলের পর এখন বিমা খাতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, আপনার মূল্যায়ন কী?
মির্জ্জা আজিজ: ব্যাংক, বিমা বা টেলিযোগাযোগ—যে খাতই হোক না কেন, জোর করে কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করানো ঠিক নয়। পদত্যাগের পরিস্থিতি তৈরি করাও অনুচিত। এতে গোটা অর্থনীতিতেই খারাপ বার্তা যায়। এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যান।
প্রথম আলো: নির্বাচনের আগে অর্থ পাচার বাড়ে বলে একধরনের সমালোচনা রয়েছে। দুই বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মির্জ্জা আজিজ: সংগত কারণেই এটা বলা হয়। নির্বাচনকালীন অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে অনেকেই মনে করেন, দেশের ভেতরে কী হয় না হয়, বরং উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলে তা বিদেশে পাঠিয়ে দিলে নিরাপদে থাকবে। গ্লোবাল ইনটিগ্রিটির প্রতিবেদন থেকে এটি কিছুটা অনুমান করা যায়। সম্প্রতি বেড়েছে কি না বলতে পারছি না। কারণ, হাতে হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং বিষয়ে যে একটি ইউনিট আছে, তারা তথ্য প্রকাশ করে বলে তো দেখি না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জ্জা আজিজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।