হলফনামা দেখে প্রার্থীর সম্পদ মেলাতে পারে এনবিআর

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
>

সামনে নির্বাচন, প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, হলফনামায় নিজেদের সম্পদ বিবরণীও প্রকাশ করেছেন। প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কী ধরনের ভূমিকা হওয়া উচিত, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ।

প্রথম আলো: সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রার্থীরা হলফনামায় নিজেদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সঠিকভাবে এই সম্পদের বিবরণী দিয়েছেন কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে এনবিআরের কী ধরনের ভূমিকা থাকা উচিত?
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: এ ব্যাপারে এনবিআরের ভূমিকা স্পষ্ট থাকা উচিত। বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় আয়কর অধ্যাদেশের ১০ বিবি ফরমে করদাতারা নিজেদের সম্পদ বিবরণী দেন। নির্বাচনের হলফনামায়ও প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী দিতে হয়। তাই প্রার্থীর হলফনামার সঙ্গে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণী ও এনবিআরে দেওয়া সম্পদ বিবরণী মিলিয়ে এনবিআর দেখতে পারে, সম্পদ কতটা বাড়ল বা কতটা কমল। যাঁরা আইনপ্রণেতা, তাঁদের বিষয়ে জানার অধিকার জনগণের আছে। যিনি আইন প্রণয়ন করবেন, তিনি নিজের সম্পদের বিষয়ে স্বচ্ছ থাকবেন, এটা সবাই আশা করে।
২০০৮ সালে একটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে সব মন্ত্রী ও সাংসদের সম্পদ বিবরণী নেবে। নির্বাচিত হওয়ার পর তারা আর অগ্রসর হয়নি। এমনকি ওই উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি সম্পর্কেও কোনো তথ্য জানা যায়নি।

প্রথম আলো: এনবিআর কি কখনো সাংসদদের জবাবদিহির বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল?
আবদুল মজিদ: ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে এনবিআর করদাতাদের কর পরিপালনের বিষয়ে কিছু বাধ্যবাধকতার শর্ত আরোপ করেছিল। যেমন, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকতে হবে। তখন দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের ২৭-২৮ জনের কোনো টিআইএন ছিল না। টিআইএন না থাকলে তাঁরা কীভাবে জনপ্রতিনিধিত্ব করবেন, আইন প্রণয়ন করবেন? তখন তাড়াহুড়ো করে অনেকেই টিআইএন নিয়েছিলেন। তারপরও ১-২ জন টিআইএন নেননি।
জাতীয় সংসদই হলো কর আরোপ বা রহিতকরণের একমাত্র কর্তৃপক্ষ। আর এই করারোপ বা রহিতকরণের বিষয়ে ভোট দেন জনপ্রতিনিধিরা। বাজেট পাসের আগে অর্থবিলের প্রতিটি সংশোধনীর ওপর মত দিয়ে ভোট দেন তাঁরা। যিনি জনপ্রতিনিধি হবেন, অবশ্যই তাঁকে নিজের কর দেওয়ার ক্ষেত্রে সব শর্ত পূরণ করতে হবে। নিজের কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল না হলে কীভাবে করসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করবেন?

প্রথম আলো: অনেক প্রার্থীই দামি বিলাসবহুল গাড়ি চালান, কিন্তু ঋণ করে নির্বাচন করেন। হলফনামা থেকে এমন নজিরও দেখা গেছে। তাঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ঋণের বিষয়টি ঠিক মেলে না। এই প্রসঙ্গে আপনার মত কী?
আবদুল মজিদ: অবশ্যই এনবিআর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে। প্রার্থীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ঋণ করে নির্বাচন করার বিষয়টি মেলাতে পারে এনবিআর। দামি গাড়ি চড়েন, বিলাসবহুল জীবনযাপন করলে কেন ঋণ করে নির্বাচন করতে যাবেন? এ ছাড়া একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদ কত বাড়ল, এর ব্যাখ্যা কর নথিতে থাকতে হবে।

প্রথম আলো: ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। তাহলে করখেলাপিদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?
আবদুল মজিদ: খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। করখেলাপির বিষয়ে আমার মত হলো, যাঁরা করখেলাপি তাঁরা তো রাষ্ট্রের দায় পরিশোধ করতে পারেন না। তিনি কর বিষয়ে নন-কমপ্লায়েন্ট। কর আইনের প্রতি যদি কোনো সাংসদের শ্রদ্ধা ও জবাবদিহি না থাকে, তবে তিনি কীভাবে কর আইন প্রণয়ন করবেন?

প্রথম আলো: ব্যবসায়ীরা বেশি কর দেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। এ অবস্থার নিরসন কীভাবে করা যায়?
আবদুল মজিদ: ছোট করদাতারা কর দিতে চান। তাঁদের মধ্যে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কম। বড় ব্যবসায়ীরা বেশি কর দেন। তাঁরা ফাঁকি দিলে তা হয়ে যায় অনেক টাকা। সে জন্য তাঁরা সেই চেষ্টা (কর ফাঁকি) করেন। ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ীর ২৫ কোটি টাকা কর হয়েছে। তিনি মামলা করে তা দীর্ঘদিন আটকে রাখেন কিংবা ঘুষ বা অন্য কোনো উপায়ে কর কমাতে চেষ্টা করেন।

প্রথম আলো: কর জাল বৃদ্ধি করার উপায় কী? এখনো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে করের অংশ ১০-১১ শতাংশ। গ্রামেও এখন অনেকে করযোগ্য আয় করেন। এনবিআরের কী করা উচিত?
আবদুল মজিদ: এনবিআর চেষ্টা করছে উপজেলা পর্যায়ে যাওয়ার। উপজেলা পর্যায়ে এখন কর মেলা হচ্ছে। কর অফিসগুলো করদাতাদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। জেলার শহরের কর কার্যালয়ে বারবার গিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে করদাতারা কর দিতে চাইবেন না। তাই কর অফিসগুলো উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে স্থানীয় করদাতারা সহজেই কর দিতে পারবেন। কোনো হয়রানির শিকার হবেন না, সেই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখনো জিডিপির ৫ শতাংশের সমপরিমাণ কর আদায় করা যাচ্ছে না। এই ৫ শতাংশের মধ্যে আছে বিদেশে টাকা পাচার, প্রকল্পের বাড়তি খরচ, কর রেয়াত এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া কর।

প্রথম আলো: নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন চালু করা সম্ভব হয়নি। নতুন আয়কর ও কাস্টমস আইনগুলো পড়ে আছে। কেন?
আবদুল মজিদ: ভ্যাট আইনের ক্ষেত্রে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের সদিচ্ছার সম্মিলন ঘটেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা পাওয়ার জন্য ২০১২ সালে আইনটি করা হয়েছিল। কিন্তু আইনটি পাস করার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মূল আলোচনা শুরু হয়। আবার যেসব সাংসদ আইন পাস করলেন, তাঁরা তা প্রবর্তন করতে পারলেন না। আইনটি পাস করার আগেই জটিলতার বিষয়গুলো সাংসদদের ভাবা দরকার ছিল।