'নিয়মনীতির সর্বজনীন কোনো প্রয়োগ নেই'

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ফাইল ছবি
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ফাইল ছবি

রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মনীতি সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ না করার কারণে ঋণ ও করখেলাপিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যেসব নিয়মনীতির মাধ্যমে আমরা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চাই, সেগুলো তারা দখল করে নিয়েছে। নিয়মনীতির কোনো সর্বজনীন প্রয়োগ নেই। কিছু কিছু লোক খেলাপি ঋণকে সমন্বয় করতে পারছে। আবার প্রকৃত উদ্যোক্তা হয়েও কিছু লোক ঋণ নিয়ে অসুবিধার মধ্যে আছে। নিয়মনীতি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে প্রয়োগের কারণেই তা এক অর্থে হাইজ্যাক হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, নিয়মকানুন সমভাবে প্রয়োগই দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকলে এটি ফিরিয়ে আনা সহজ হতো।

রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল রোববার বর্তমান সরকারের গত ১০ বছরের শাসনকালের অর্থনৈতিক বিষয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডি। সেই অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

এর আগে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘খেলাপি হিসেবে যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের ঋণের পরিমাণ বড় বিষয় না। আমরা প্রকাশ্যে যেটুকু জানি, বড় বড় ঋণগ্রহীতারা বহু আগেই তাঁদের প্রভাব ও অন্যান্য সংযোগ ব্যবহার করে ঋণকে সমন্বয় করে নিয়েছেন অথবা অন্য ব্যবস্থার মধ্যে আছেন। ফলে লোক দেখানো একটি ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সেটির মূল্যায়ন করার প্রকৃত জায়গা নির্বাচন কমিশন না। সেটির মূল্যায়ন করার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।’

এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচনী ব্যয় নিয়েও কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নির্বাচনী ব্যয় এখন অনেক সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। এখন যে ব্যয় হয়, তা বহন করে অনেকের পক্ষেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব নয়। তাই নির্বাচনের ব্যয় গণতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়েছে কি না, সেটি বিবেচনা করার সময় এসেছে। হলফনামা ও নির্বাচনী ব্যয়বিষয়ক একাধিক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রার্থীরা যেসব তথ্য দেন, তা পরিবীক্ষণ করে কেউ সত্যতা যাচাই করে না। সেই সক্ষমতা বা আগ্রহ নির্বাচন কমিশনের আছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি। সম্পদ বিবরণী দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এগুলো পর্যালোচনা করে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দিতে পারে।’

সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন দেশের অন্যতম সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হলে রাষ্ট্রের বিচার, কর ও ব্যাংক ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো অন্যান্য সংস্থার মধ্যে সামগ্রিক সমন্বয় থাকতে হবে। কিন্তু সেটি আমরা দেখি না। সেটির একটি কারণ প্রশাসনিক স্থবিরতা। সে জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগও নেই।’

সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে পরিমাণগত উন্নয়ন হয়েছে। একই সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। অধিকার রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারে তাহলে বৈষম্য কমানোর চেষ্টা বাস্তবায়িত হবে না। নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। নাগরিক সমাজ নিরাপদে ও ভীতিহীনভাবে বক্তব্য দিতে পারে, বিনিয়োগকারীদের সংগঠনগুলো যেন তাদের সমস্যাগুলো উচ্চ স্বরে বলতে পারে এবং সে কারণে তাদের ওপর চাপ না আসে—সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নাগরিক অধিকার, উদ্যোক্তা, গরিব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা না করে বৈষম্য কমানোর চেষ্টা সফল হবে না।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাবলি যেভাবে এগোচ্ছে সেখানে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী আলোচনায় কোনো অর্থনৈতিক বিষয়াবলি আসেনি। নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা করবে—এসব বিষয়ের প্রাধান্যই রয়েছে। জীবন–জীবিকার বিষয় রাজনৈতিক বিতর্কে স্থান পায়নি। সেটিকে যতটা সম্ভব নিয়ে আসতে হবে। আগামী দিনের জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিতে হবে যে উন্নয়ন অব্যাহত রেখে বৈষম্য কমাতে হবে এবং গুণ–মানসম্মত প্রবৃদ্ধি দিতে হবে, যাতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষটিও এই উন্নয়ন থেকে উপকৃত হয়। আমরা দেখেছি, গত ১০ বছরে উন্নয়নের সম্পদ সমভাবে বণ্টিত হয়নি।’