বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসন্তোষ

যশোরের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক
যশোরের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক

তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন দেখানো যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এক বছরেও আশা জাগাতে পারেনি। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের (বিএইচটিপিএ) উদাসীনতায় ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পার্কের ব্যবস্থাপনায় টেকসিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে অসম চুক্তি হওয়ায় পার্কে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পার্কের জায়গার ভাড়া বাবদ সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, ১২ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান ও সফটওয়্যার রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে যশোরের বেজপাড়া শংকরপুর এলাকায় ২ লাখ ৩২ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সফটওয়্যার টেকনোলজির এই পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পার্কটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পার্কে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসহ রয়েছে ১৫ তলাবিশিষ্ট মূল ভবন ও উন্নত মানের ১২ তলা আবাসিক ভবন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে দেশি-বিদেশি ৪০টি প্রতিষ্ঠান বিএইচটিপিএর সঙ্গে চুক্তি করে পার্কে জায়গা বরাদ্দ নেয়। চুক্তি অনুযায়ী, মাসিক ভাড়াসহ অন্যান্য বিষয়ে লেনদেন হওয়ার কথা বিএইচটিপির সঙ্গে। অথচ উদ্বোধনের কিছুদিন পর সরকার পার্কটি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (পিএমসি) হিসেবে টেকসিটি নামের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী পার্কের রাজস্ব আয়ের ৮২ শতাংশ ভোগ করছে টেকসিটি। আর সরকার পাচ্ছে অবশিষ্ট ১৮ শতাংশ।

তবে পার্কে বিনিয়োগকারী ১৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্প্রতি বিএইচটিপিএর কাছে চিঠি দিয়ে বলেছেন, তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁরা ভাড়ার টাকা দিতে চান না। প্রতিষ্ঠানগুলো পে-অর্ডার চেকের মাধ্যমে হাইটেক কর্তৃপক্ষের কাছে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করছে। বর্তমানে ৫৩টি কোম্পানি এ পার্কে বিনিয়োগের জন্য জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি কোম্পানি তাদের কার্যালয়ের সাজসজ্জার কাজ করেছে। গত রোববার পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, ১৫ তলাবিশিষ্ট এমটি ভবনের প্রতিটি তলাতেই অর্ধেকের বেশি জায়গা খালি পড়ে রয়েছে। অনেক কোম্পানি ডেকোরেশন করে ফেলে রেখেছে।

পার্কটিতে একমাত্র বিদেশি বিনিয়োগ জাপানের ডেসটিনি ইনকরপোরেশনের। প্রতিষ্ঠানটিতে সফটওয়্যার ডেভেলপারের কাজ করেন সাতজন তরুণ-তরুণী। তবে ব্যাংক হিসাব খোলার জটিলতার কারণে ৯ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না তাঁরা। প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘চুক্তিপত্র অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানি হিসেবে আমাদের ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেবা দেওয়ার কথা। কিন্তু বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসহ কোনো কিছুই গত ৯ মাসে দেওয়া হয়নি। অনুমোদন না থাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা যায়নি। সে জন্য জাপান থেকে টাকা পাঠাতে পারছে না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা কল্যাণ সরকার বলেন, ‘বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কাছে কাগজপত্র চেয়েছি। কিন্তু তাঁরা তা দিচ্ছেন না। তাঁরা কাগজপত্র ছাড়াই অনুমোদন পেতে চায়। এটা কী করে হবে?’

এদিকে অংশ ইন্টারন্যাশনাল ও টেকনো সফট বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী গত মাসে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাঁদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘টেকসিটিকে পার্কের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতি বর্গফুট জায়গার জন্য মাসিক ভাড়া বাবদ সরকারকে দিচ্ছে মাত্র ১ টাকা ৮০ পয়সা। আর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বর্গফুটের জন্য ভাড়া গুনছে ১০ টাকা। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। এ ছাড়া পার্কের এমটি ভবন ডেটা সেন্টার স্থাপনের জন্য উপযোগী নয়। এ বিষয়ে আগে থেকেই বিএইচটিপিএর নির্দেশনা ছিল। তারপরও টেকসিটিকে ডেটা সেন্টার স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’

এমটি ভবনের ষষ্ঠ তলায় ডেটা সেন্টার স্থাপন করতে চায় টেকসিটি। এমনটি জানিয়ে মাইক্রো ড্রিম আইটির স্বত্বাধিকারী শাহানুর শরীফ বলেন, ‘ডেটা সেন্টার করার জন্য আমার কোম্পানিকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। রাজি না হওয়ায় নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। জায়গা না দিয়ে ডেটা সেন্টার স্থাপন করলে দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির উদ্যোগ সফল হবে না।’

জানতে চাইলে টেকসিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদ শরীফ বলেন, ‘বিদ্যুৎ ব্যবহারসহ অন্যান্য সুবিধার জন্য ইভেন্ট টেক ও মাইক্রো ড্রিম আইটি কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে অন্য তলায় যেতে বলা হয়েছিল। তারা যেতে না চাইলে কোনো সমস্যা নেই। তবে যখন যা হয়েছে, তা হাইটেক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই করা হয়েছে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে টেকসিটি কর্তৃপক্ষের ভাড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি রয়েছে। একাধিকবার বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টাও করা হয়েছে। নির্বাচনের পর এ বিষয়ে উভয় পক্ষকে নিয়ে সমঝোতা করা হবে।’