আন্তর্জাতিক কল কমছে, দাম বাড়ছে

দেশে বৈধ পথে বিদেশ থেকে কল আসার পরিমাণ দিন দিন কমছে। ২০১৫ সালে যেখানে দিনে ১২ কোটি মিনিট পর্যন্ত কল আসত, চলতি মাসে তা সর্বনিম্ন ৩ কোটি ২০ লাখ মিনিটে নেমেছে। এতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) অপারেটর, ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) ও গ্রাহকের অপারেটর, তথা মোবাইল ফোন ও টেলিফোন অপারেটরদের আয় কমছে।

বৈধ পথে কল কমার কারণ দুটি—অবৈধ ভিওআইপি এবং হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোর মতো ওভার দ্য টপ সেবা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের ক্ষেত্রে উচ্চ মাশুলের কারণেই অবৈধ ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল বা ভিওআইপি উৎসাহিত হচ্ছে। অবৈধ ভিওআইপিতে কল টার্মিনেশনের খরচ অনেক কম পড়ে।

বিটিআরসি সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের ক্ষেত্রে মাশুল পুনর্নির্ধারণ করে। এতে সর্বনিম্ন কল টার্মিনেশন রেট ধরা হয় ১ দশমিক ৭৫ সেন্ট বা ১ টাকা ৪৭ পয়সা (ডলার প্রতি ৮৪ টাকা ধরে)। আর সর্বোচ্চ ধরা হয় আড়াই সেন্ট বা ২ টাকা ১০ পয়সা। বিটিআরসির তখনকার নির্দেশনায় বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য কল আনতে হবে আড়াই সেন্ট দরে। বিপরীতে আয় ভাগাভাগি হবে সর্বনিম্ন হারে। এ নির্দেশের আগে আইজিডব্লিউগুলো দুই সেন্টে কল আনত, যদিও তাদের পক্ষে এটা সাড়ে তিন সেন্ট পর্যন্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল।

অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক কলরেট বাড়ানো ও আয় ভাগাভাগির শর্ত নির্ধারণ করা হয় আইজিডব্লিউ অপারেটরদের স্বার্থে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যরা। কারণ, প্রকৃত দরের বদলে সর্বনিম্ন দরে আয় ভাগাভাগি করার কারণে বড় একটি অংশ পায় আইজিডব্লিউ অপারেটররা। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ২৬টি আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়—যার বেশ কিছু সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা পান। দেশে আইজিডব্লিউর সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে থাকার পরও সরকারের শেষ দিকে এসে সম্প্রতি বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে একটি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে আইজিডব্লিউ অপারেটরের সংখ্যা ২৪টি। পাওনা অর্থ না দেওয়ায় বিভিন্ন সময় ছয়টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে বিটিআরসি। তাদের কাছে বকেয়া আছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। বর্তমান অপারেটরগুলো একটি জোট করে কল ভাগাভাগি করছে, যাতে প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ হয়ে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি ব্যয় চাপছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অবশ্য আইজিডব্লিউ অপারেটররা কল রেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কল কমার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করছে। তাদের মতে, অবৈধ ভিওআইপি এত বেশি যে বিটিআরসির অভিযানে তেমন একটা সুফল মিলছে না। মোবাইল ফোন অপারেটরদের সিম কীভাবে ভিওআইপিতে ব্যবহৃত হয়, তার একটা বিহিত করা উচিত।

কল কমছে
আন্তর্জাতিক কলের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত দেশে প্রতিদিন গড়ে ১২ কোটি মিনিট কল আসত, তখন কার্যকর কল টার্মিনেশন রেট ছিল দেড় সেন্ট বা ১ টাকা ২০ পয়সা। ওই সময়ের মধ্যে একপর্যায়ে এক দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ কোটি মিনিট কল আসারও রেকর্ড রয়েছে। ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট কল রেট দেড় সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ২ সেন্ট নির্ধারণ করে আইজিডব্লিউ অপারেটররা। এর ফলে সে সময়ই বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল আসা ২৮ শতাংশ বা ৩ কোটি মিনিট কমে ৯ কোটি মিনিটে নেমে আসে।

এরপর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট ২ সেন্ট থেকে আবারও বাড়িয়ে আড়াই সেন্ট করা হয়। ফলে জানুয়ারি মাসেও যেখানে দিনে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল আসত, এখন সেটা কমতে কমতে ৩ কোটি মিনিটে নেমে এসেছে। এ হিসেবে গত তিন বছরে দেশে আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ প্রায় ৭৫ শতাংশ কমেছে।

এই কল থেকে যে রাজস্ব আয় হয়, তার ৪০ শতাংশ বিটিআরসি, ২০ শতাংশ আইজিডব্লিউ, সাড়ে ১৭ শতাংশ আইসিএক্স এবং সাড়ে ২২ শতাংশ সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অপারেটর বা এক্সেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস (এএনএস) পায়।

ভারতে কমেছে কলরেট
এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল বাড়াতে কলরেট কমানো হয়েছে। ভারতের টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (টিআরএআই) গত ফেব্রুয়ারিতে কল টার্মিনেশন রেট শূন্য দশমিক ৫৩ রুপি থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩০ রুপি করেছে।

বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কলসংখ্যা ও সরকারের আয় বাড়াতে গত বছরের এপ্রিলে কল রেট কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আয় ভাগাভাগির ক্ষেত্রেও সমতা, অর্থাৎ যে মূল্যে কল আসবে, সেই মূল্যেই ভাগাভাগি করার চিন্তাও করা হয়েছিল। কিন্তু তা আর এগোয়নি।

এ বিষয়ে বিটিআরসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কল রেটের বিষয়টি ঠিক করে মূলত টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। বিটিআরসি শুধু আনুষ্ঠানিকতার কাজটুকু করে। তিনি বলেন, বৈধ কল কমে যাওয়ায় সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। কলরেট এমন হওয়া উচিত যেখানে অবৈধ ভিওআইপি নিরুৎসাহিত হয়।