বন্দর নিয়ে নতুন কোনো অঙ্গীকার নেই কারও

চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দর

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব বাড়ছে। তবু এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বন্দর নিয়ে সুনির্দিষ্ট সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেই। অথচ বন্দর নিয়ে এই অঞ্চলে অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত মঙ্গলবার আলাদাভাবে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ক্ষমতায় থাকার সময় যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। ফাইলবন্দী থাকা সোনাদিয়া প্রকল্পও রাখা হয়েছে তাতে। বিএনপি তাদের ইশতেহারে বন্দর নিয়ে কোনো কথা বলেনি। অবশ্য বিএনপির নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে চারটি বন্দরের উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নৌপথ ও বন্দর বিষয়ে পাঁচটি লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে ২০২৩ সালের মধ্যে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। বে টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরা হয়। তবে এ টার্মিনাল নির্মাণের ক্ষেত্রে সময়সীমা নিয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। অবকাঠামো উন্নয়নে বৃহৎ প্রকল্পে সাফল্য ও অর্জনের মধ্যে পায়রা ও সোনাদিয়া বন্দরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে ইশতেহারে জানানো হয়।

বিএনপির ইশতেহারে বন্দর নিয়ে কোনো কথা নেই। তবে অর্থনীতি বিষয়ে দলটি বলছে, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। তবে তাদের নির্বাচনী জোট ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী ইশতেহারের ২২ নম্বরে বলেছে, ‘সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করা হবে। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দ্রুত প্রকল্প নেওয়া হবে।’ এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা মাতারবাড়ী বন্দর, বে টার্মিনাল বা পায়রা বন্দরের কী হবে, তা উল্লেখ নেই।

ইশতেহারের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির ইশতেহারে যে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কথা বলছে, তা বাস্তবায়নে অন্য বিষয়ের মতো বন্দর নিয়েও বিশেষ কর্মসূচি থাকা উচিত ছিল। তবে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। আবার তাদের ইশতেহারে সোনাদিয়া বন্দর বাস্তবায়নাধীন আছে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা আসলে ভারত অবস্থান না বদলালে কখনোই হবে না। যদিও মাতারবাড়ী বন্দর হলে সোনাদিয়ার অভাব অনেকখানিই মিটে যাবে। তবে সব মিলিয়ে নতুন বন্দর নির্মাণ বা উন্নয়নে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল।

গত এক দশকে দেশের বন্দরগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মহাজোট সরকারের সময় বন্দর নিয়ে অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ভূরাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে পায়রা বন্দরকে স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেও তাতে সফল হয়নি সরকার। ফলে পণ্য পরিবহনে অবকাঠামো সংকটের জেরে এই সরকারের চলতি মেয়াদের শেষের দিকে এসে আড়াই বছর ভুগতে হয়েছে শিল্পমালিকদের। আমদানি পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যয় হয়েছে গত বছর। দিন শেষে এর মাশুল দিয়েছে সাধারণ ভোক্তারা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে অন্যতম প্রয়োজনীয় অবকাঠামো হলো বন্দর। আবার সমুদ্র অর্থনীতির প্রয়োজনেও বন্দরের গুরুত্ব বেশি। এই দুইভাবে বন্দরের গুরুত্ব বাড়লেও রাজনৈতিক দলের ইশতেহারগুলোতে বন্দর নিয়ে কার্যকর মনোযোগের বিশ্বাসযোগ্য উপাদান খুঁজে পাওয়া কঠিন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অঞ্চলে বন্দর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রথম আলোচনায় আসে ভারত। ২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহারে সাগরমালা প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। এই প্রকল্পের আওতায় বন্দরগুলোর উন্নয়নই ছিল মুখ্য। রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকার কারণেই ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে বন্দর উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হচ্ছে।

বন্দর বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশে বন্দর নিয়ে আঞ্চলিক গুরুত্ব দেখা দেয় এক দশক আগে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশের পর। সম্ভাবনাময় এই প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায় চীন, ভারতসহ সাতটি দেশ। ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের সময় সমঝোতা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে যে এই চুক্তি হয়নি, তা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছেন। সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ থেকে পিছিয়ে আসার পর পায়রা বন্দর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পায়রা বন্দরে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় জাপানের অর্থায়নে মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে বে টার্মিনাল নির্মাণেরও প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

চট্টগ্রাম ও মোংলা দুই বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। ইশতেহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গতকাল বলেন, ‘বন্দর নিয়ে পরিকল্পনা ও সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রমে আমাদের দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে বন্দর ব্যবস্থাপনা সামগ্রিকভাবে দেখা হয় না। এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেভাবে বাড়ছে, তাতে বন্দর নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। শুধু চট্টগ্রাম, মোংলা বা পায়রা বন্দরকে আলাদা করে না দেখে সমন্বিতভাবেই পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। আমাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য কতটি বন্দর দরকার, কোনটি আগে করতে হবে, ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়ন কীভাবে হবে—এসব বিষয়ে ৫০ বছর মেয়াদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।’