বাংলাদেশ এখন সফলতার গল্প

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

জাপানের পত্রিকা নিক্কি এশিয়ান রিভিউর চোখে বাংলাদেশ এখন একটি সফলতার গল্প। পত্রিকাটি বলছে, উল্লেখযোগ্য হারে আন্তর্জাতিক নজর ছাড়াই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ দেশের পোশাক খাত চীনের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে বড় হচ্ছে। ২০০৯ সালের পর মাথাপিছু আয় তিন গুণ হয়েছে। ক্ষুধা জয় করে বাংলাদেশ এখন সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।

নিক্কির প্রতিবেদনটি গতকাল বুধবার প্রকাশ করা হয়। এটির শিরোনাম, ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড রাইজ অব বাংলাদেশ: দ্য ইকোনমি ইজ বুমিং, ডাজ শেখ হাসিনা ডিজার্ভ দ্য ক্রেডিট।’ এর মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি কৃতিত্ব আশা করতে পারেন?

নিক্কি ইনকরপোরেশন জাপানের একটি প্রকাশনা সংস্থা। তাদের নিক্কি পত্রিকাটি ১৪০ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। একই গোষ্ঠীর ইংরেজি ভাষার ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক জার্নাল নিক্কি এশিয়ান রিভিউ। বাংলাদেশ নিয়ে নিক্কি এশিয়ান রিভিউতে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে, সেটিকে তারা মূল প্রতিবেদন বা কভার স্টোরি বলছে। প্রতিবেদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া, পোশাক ছাড়াও অন্যান্য খাতের অগ্রগতি, বড় প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, চীনের বিনিয়োগ ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। তুলে ধরা হয়েছে আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গও।

নিক্কির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশকে মানুষ চিনত দরিদ্র ও দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে। এখন বাংলাদেশকে সামলাতে হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বড় সংকট, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল। এত কিছুর পরও বাংলাদেশ থেমে নেই। চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ একটি মাহেন্দ্রক্ষণ উদ্‌যাপন করেছে, যখন জাতিসংঘের মানদণ্ডে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

নিক্কি বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন দেশের ভাবমূর্তির জন্য বড় অর্জন। নিক্কির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি আমাদের আত্মশক্তি জুগিয়েছে। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের জন্য নয়, জনগণের জন্যও আত্মশক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, ‘আপনি যখন নিচের দিকে থাকবেন, তখন প্রকল্পের শর্তের ক্ষেত্রে অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। যখন আপনি উন্নয়নশীল হবেন, তখন অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে না।’   

অর্থনৈতিক অগ্রগতির আকর্ষণীয় সংখ্যা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে গভীর রাজনৈতিক বিভাজন দেশটিকে তাড়িয়ে বেড়ায় বলে উল্লেখ করা হয় নিক্কির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ বিভাজন আরও সম্মুখে চলে এসেছে। তিন দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পালাক্রমে ক্ষমতায় থেকেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা এখন কারাগারে, যদিও অভিযোগকে মিথ্যা বলছেন তিনি। ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলটি অতীতের কয়েকটি নির্বাচনে শক্ত জনসমর্থন পেয়েছে। কিন্তু বিরোধীরা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছে।

নিক্কি বলছে, আওয়ামী লীগ টানা দুই মেয়াদ পার করার পর বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ভোটারদের একটি অংশের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব দেখতে পাচ্ছেন। যদিও অনেকেই একমত যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। এ বিষয়ে হংকংভিত্তিক ব্রোকারেজ হাউস সিএলএসএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টোফার উড নিক্কিকে বলেন, বড় ধরনের দ্বন্দ্ব ছাড়া নির্বাচন হয়ে গেলে এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা হলে বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে একটি আকর্ষণীয় গল্প মনে হতে পারে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন বাড়ছে বলে যে সমালোচনা—তা উড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে নিক্কির প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ।’

নিক্কির প্রতিবেদকের মনে হয়েছে, স্থিতিশীলতার স্বার্থে হলেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ সরকারের পক্ষে। পত্রিকাটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কয়েক জন নির্বাহী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা নাকচ করে দেন। পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা স্বস্তি বোধ করছি যে সব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আমরা জানি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতি এগোতে পারে না। তারপরও আমরা আশাবাদী, আমরা অর্থনীতিকে মতবিরোধের বাইরে রাখতে পারব।’

নিক্কির প্রতিবেদনে নানা প্রসঙ্গের মধ্যে অবকাঠামো ঘাটতির বিষয়টিও উঠে আসে। আসে চীনা বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্যতম দুর্বলতা অবকাঠামোর অভাব। এ ক্ষেত্রে দেশটি চীনের সহায়তা নিচ্ছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর উদ্যোগে চীনারা বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। দেশটি বাংলাদেশকে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ঋণ ও বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। নিক্কি বলছে, চীনের বড় বিনিয়োগ নিয়ে সমালোচনাও আছে। অবশ্য বাংলাদেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো চীনের ঋণ-কূটনীতির কবলে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা নাকচ করে দেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা।

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ফায়েজ সোবহান বলেন, ‘আমার মনে হয় না, বাংলাদেশ চীনের প্রতি ততটা ঝুঁকে পড়েছে, যতটা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান পড়েছে। বাংলাদেশ কিন্তু জাপানের কাছ থেকেও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ নিচ্ছে।’

প্রতিবেদনের শেষ দিকে দুটি তথ্য উল্লেখ করা হয়, প্রথমটি হলো চীনা বিনিয়োগকারীরা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ শতাংশ মালিকানা নিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চীনা সামরিক সরঞ্জামের আমদানিকারক। নিক্কি বলেছে, অনেকে যখন বেইজিং থেকে এত বেশি বিনিয়োগ আসা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তখন শেখ হাসিনা বলেন, চীন এই অঞ্চলে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে চায়। এটা এর বেশি কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বিদেশনীতি একেবারেই পরিষ্কার, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কী করছে, সেটা তাদের বিষয়।’