ব্যবহৃত হচ্ছে না বহির্নোঙরও

পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে জাহাজ বেঁধে রাখার জন্য রয়েছে ভাসমান মুরিং বয়া। বহির্নোঙর থেকে এ পথেই বন্দরে ভিড়বে জাহাজ। যদিও বন্দর ব্যবহারকারীরা আগ্রহী না হওয়ায় এ বন্দরে ভিড়ছে না আশানুরূপ জাহাজ। সম্প্রতি তোলা।  ছবি: প্রথম আলো
পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে জাহাজ বেঁধে রাখার জন্য রয়েছে ভাসমান মুরিং বয়া। বহির্নোঙর থেকে এ পথেই বন্দরে ভিড়বে জাহাজ। যদিও বন্দর ব্যবহারকারীরা আগ্রহী না হওয়ায় এ বন্দরে ভিড়ছে না আশানুরূপ জাহাজ। সম্প্রতি তোলা। ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে সমুদ্রগামী জাহাজ থেকে খোলা পণ্য বা কনটেইনারবিহীন পণ্য খালাস শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের আগস্টে। এরপর দুই বছর তিন মাসে পায়রা বন্দরের জলসীমা ব্যবহার করে ২৫টি জাহাজে পণ্য এনেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে পায়রা বন্দরের আশপাশের প্রকল্প ও কারখানার কাঁচামাল বা যন্ত্রপাতি আনা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে।

বহির্নোঙরে বা সাগরে বড় জাহাজ থেকে খোলা পণ্য (কনটেইনারবিহীন পণ্য) খালাস করার জন্য বড় কোনো অবকাঠামো দরকার হয় না। বড় জাহাজ সাগরে রেখে সেখান থেকে লাইটার জাহাজে যন্ত্রের সাহায্যে পণ্য স্থানান্তর করে তা নদীপথে দেশের বিভিন্ন ঘাটে নিয়ে খালাস করা যায়। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য, স্ক্র্যাপ বা বাতিল লোহা, সারের মতো খোলা বা বস্তাবোঝাই পণ্য এভাবে বহির্নোঙরে খালাস করা হয়।

গত ১৮ নভেম্বর সরেজমিনে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় লালুয়া ইউনিয়নে প্রস্তাবিত পায়রা বন্দর ঘুরে রাবনাবাদ চ্যানেলে কোনো জাহাজ চোখে পড়েনি। নদীর অপর পারে দেখা যায়, উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাঠামো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চীন থেকে এই প্রকল্পের সব সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতি আনা হচ্ছে। তবে পায়রা বন্দরের ঘরের কাছে এই প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আনা হচ্ছে ২৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও জেটি দিয়ে। কিছু যন্ত্রপাতি ২৩১ কিলোমিটার দূরের মোংলা বন্দরের বহির্নোঙর ও জেটি ব্যবহার করে আনা হচ্ছে।

পায়রা বন্দরে টার্মিনাল নির্মাণ না হওয়ায় ভারী যন্ত্রপাতি খালাসের সুযোগ নেই। তবে বহির্নোঙরে খালাস করা যায়, এমন যন্ত্রপাতিবাহী জাহাজ পায়রা বন্দরে নিয়ে খালাসের সুবিধা ছিল। এরপরও তা নেয়নি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি খালাস ও পরিবহনে যুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য স্টিভিডোরিং প্রতিষ্ঠানগুলোর যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়নি। আবার এক জাহাজে অনেকগুলো প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আনা হয়। ফলে পায়রায় এনে তা খালাস করা ব্যয়বহুল। আবার শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার জন্য একাধিক স্থানে যেতে হয়।

পায়রা বন্দরের বহির্নোঙর ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছের এলাকা পটুয়াখালী ও বরিশাল। এই দুই এলাকায় শিল্পকারখানা হাতে গোনা। বরিশালের রূপাতলী এলাকায় অলিম্পিক সিমেন্টের কারখানা থাকলেও তারা পায়রা বন্দরের বহির্নোঙর সুবিধা নিচ্ছে না। অ্যাংকর ব্র্যান্ডের এই সিমেন্ট কারখানার জন্য বছরে পাঁচ লাখ টন কাঁচামাল আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।

পায়রা বন্দর ফেলে কেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করছেন—জানতে চাইলে অলিম্পিক সিমেন্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মোহাম্মদ সাহেদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে বন্দরসুবিধা চট্টগ্রামের চেয়ে অনেক কম। আবার পায়রা থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে গভীরতা কম থাকায় ছোট জাহাজেও পণ্য আনতে অসুবিধা হয়। এ জন্যই তাঁরা চট্টগ্রামমুখী।

পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাস হওয়া প্রথম জাহাজ ছিল ক্লিংকারবাহী। এফএস বিচ নামের জাহাজটিতে মাত্র ১২ হাজার ২০৩ টন ক্লিংকার আনা হয়। মদিনা গ্রুপ মেঘনা ঘাটে অবস্থিত তাদের সিমেন্ট কারখানার জন্য এই ক্লিংকার এনেছিল। তবে এখন তারা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে কাঁচামাল আমদানি করছে।

জানতে চাইলে মদিনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ নেভিগেশনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সাগর থেকে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেল পর্যন্ত নৌপথে গভীরতা কম। ফলে বড় জাহাজ চ্যানেলে নেওয়া যায় না। আবার পায়রার জলসীমায় সাগরে রোলিং (উত্তাল ঢেউ) বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে সিমেন্ট কারখানায় কাঁচামাল পরিবহনে অন্যান্য নৌপথের চেয়ে সুবিধা বেশি।

পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে খালাস হওয়া পণ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বহির্নোঙরে খালাস হওয়া ২৫টি জাহাজের পণ্যের মধ্যে সিংহভাগই ছিল পাথর। এ ছাড়া সিমেন্টের ক্লিংকার, যন্ত্রপাতি ও নৌকা আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে দুই বছর ধরে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত কোনো জাহাজ ভেড়েনি।

বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে ব্যবসায়ীদের অনাগ্রহের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর এম জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, পায়রা বন্দরে জেটি না হওয়ায় ভারী যন্ত্রপাতি নামানোর সুযোগ নেই। তবে খননকাজসহ টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প শেষ হলে ২০২১ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে পণ্য পরিবহন শুরু হবে।

ব্যবসায়ীরা জানান, তুলনামূলক কম সময় ও কম খরচে যে বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন সুবিধা মিলবে, সেখানেই যাবেন ব্যবসায়ীরা। পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে এখনো সেই ধরনের সুবিধা তৈরি হয়নি বলে ব্যবসায়ীরা এখনো চট্টগ্রামমুখী।

দেশে যেসব খোলা পণ্য আমদানি হয়, তার বড় অংশই ঢাকার বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্প–কারখানার জন্য আনা হয়। গত ১৭ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা হয়ে বরিশালে যাওয়ার পথে দেখা যায়, চট্টগ্রাম থেকে সারি সারি লাইটার জাহাজে করে পণ্য নিয়ে এসে নদীতীরের কারখানাগুলোর সামনে ভেড়ানো হচ্ছে।

বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, চট্টগ্রামের চেয়ে পায়রা বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ঢাকা অঞ্চলের দূরত্ব বেশি। পায়রা বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত নৌপথে দূরত্ব ২৩২ কিলোমিটার। পায়রা থেকে এ দূরত্ব ২৬৭ কিলোমিটার। আর মোংলা থেকে দূরত্ব ৩৫৪ কিলোমিটার। এ কারণেই ঢাকা অঞ্চলের গন্তব্যে থাকা কারখানাগুলোর প্রধান পছন্দ চট্টগ্রাম। দূরত্বের সঙ্গে খরচ যোগ হয়ে পায়রা ব্যবহারে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।