বছরজুড়ে আলোচনায় ব্যাংক খাত

ব্যাংক ব্যবসা যে কতটা স্পর্শকাতর, তা চলতি বছরের শুরুতেই ভালোভাবে টের পান ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এক ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারায় বেশির ভাগ ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। তাতে সংকটে পড়ে পুরো ব্যাংক খাত।

এ সংকট চলাকালেই ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশনা আসে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। ব্যাংক পরিচালকেরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নানাবিধ সুবিধা আদায় করে নেন। আর আমানতকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে সরকার, ব্যাংকের পরিচালক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাতে হাত মেলায়। এর ফলে অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা।

জনতা ব্যাংকে অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ জালিয়াতি নিয়ে পুরো খাতই ছিল আলোচনায়। ফলে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। তাতে মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়।

ব্যাংক খাতে যে কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে, বছর শেষে তার কিছুটা সত্যতা মেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সংলাপে তুলে ধরা তথ্যে। সংস্থাটি জানায়, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। আমানত সংকট, ঋণ কেলেঙ্কারি, সুদহার কমিয়ে আনাসহ নানা কারণে বছরজুড়ে ব্যাংক খাত ছিল সমালোচনায়।

ব্যাংক খাতের জন্য বছরটি কেমন গেল, এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ‘অনেক চ্যালেঞ্জিং বছর ছিল। আমানতের সংকট ছিল, খেলাপি ঋণও অনেক বেড়েছে।’ সামনের বছর প্রধান চ্যালেঞ্জ কী হবে, এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরে প্রবৃদ্ধির গতির সঙ্গে ব্যবসাও ভালো হবে। তারল্য জোগান দিতে বন্ড মার্কেটের দিকে যেতে হবে। টাকাকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে হবে। আর খেলাপি ঋণ আদায় হবে অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’

জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংক পুরো খাতে সংকট তৈরি করার পর ব্যাংকটিকে বাঁচাতে সরকারের নির্দেশে এগিয়ে আসে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। মূলধন সহায়তা ও বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটিকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি পরিচালনারও দায়িত্ব নেয় তারা।

বছরের শুরু থেকে নানামুখী সংকটে পড়ে ব্যাংক খাত। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ-আমানতের অনুপাত কমিয়ে দেয়। এ জন্য ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চাপ দেয়। এ নিয়ে দফায় দফায় পিছু হটে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। শেষ পর্যন্ত ঋণ-আমানত অনুপাত সমন্বয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি আরও কিছু সুবিধা আদায় করে নেয় বিএবি।

এ অবস্থায় এপ্রিলে ব্যাংক পরিচালকদের এক সভায় ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর বিএবি আরও সুবিধা আদায়ে মাঠে নামে। সুদহার কমাতে নগদ জমার হার কমানো, সরকারি আমানতের অর্ধেক দাবি করে তারা। এ জন্য রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে একটি সভাও করেন বিএবি নেতারা। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকেও ডেকে আনা হয়। ওই সভাতেই বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেয় বিএবি। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে দেয় সরকার। নানা সুবিধা আদায় করা হলেও ব্যাংকঋণের সুদহার খুব একটা কমানো হয়নি।

এদিকে চলতি বছরজুড়ে জনতা ব্যাংক বারবার আলোচনায় এসেছে। অ্যাননটেক্স গ্রুপের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি নিয়ে ব্যাংকটি এখন বড় সংকটে। এ দুই বড় ঋণের বড় অংশই হয়ে পড়েছে খেলাপি।

আগের বছরগুলোর মতো চলতি বছরেও ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া নানা অনিয়ম, কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বছরের শেষ সময়ে এসে এক সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। সেখানে ১০ বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য তুলে ধরার পর তা নিয়ে ব্যাংকমালিক ও এমডিরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এসব নিয়ে বলেন, আর্থিক অনেক উন্নতি হলেও ব্যাংক খাত নাজুক হয়েছে। প্রভাবশালী ও বেসরকারি ব্যাংকের কিছু পরিচালকের কারণে এমন অবস্থা হয়েছে খাতটির। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতজানু অবস্থাও এ জন্য দায়ী। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীন রাখতে ভারতের গভর্নর পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশে এমনটি দেখা যায় না, সব মাথা পেতে নেয়। ব্যাংক খাতটি ঠিক করতে নতুন সরকারকে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।