ব্যবসার সূচকে সুখবর ছিল না

চলতি ২০১৮ সালে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ মেধাসম্পদ গড়ে তোলাসহ মানব উন্নয়নে কিছুটা অগ্রগতি আছে। এর মানে, আমরা মানব উন্নয়নে ভালো করলেও অর্থনীতির গতি ধরে রাখার সূচকগুলোতে অন্য দেশের তুলনায় ভালো করতে পারছি না। এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করা আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনগুলো ২০১৮ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়।

বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হচ্ছে না, যা অর্থনীতির গতি ধরে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক দশক ধরেই বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। তাই অবকাঠামো, জ্বালানি খাতসহ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করা দরকার। তিনি আরও বলেন, মানব উন্নয়নে তুলনামূলক ভালো করলেও এখন মানসম্পন্ন শিক্ষা ও দক্ষতার দিকে নজর দেওয়া উচিত। বাজারভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।

ব্যবসা সহজ করা
বাংলাদেশে ব্যবসা করা আগের মতোই কঠিন রয়েছে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে ২০১৯ বা সহজে ব্যবসা করার সূচক অনুযায়ী, এ বছর ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬ তম। এক বছরের ব্যবধানে মাত্র এক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে অন্য দেশগুলো বেশি এগিয়েছে।

সহজে ব্যবসা করার সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে, অবস্থান অষ্টম। এ অঞ্চলে ব্যবসা করার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবেশ রয়েছে ভারতে। এ দেশটি এবার বৈশ্বিক অবস্থানে ৭৭ তম স্থানে আছে। ভুটান ৮১ তম, শ্রীলঙ্কা ১০০ তম, নেপাল ১১০ তম, পাকিস্তান ১৩৬ তম, মালদ্বীপ ১৩৯ তম ও আফগানিস্তান ১৬৭ তম স্থানে আছে।

প্রতিযোগিতা সক্ষমতা
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বাংলাদেশ আগের চেয়ে এক ধাপ পিছিয়ে গেছে। গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক বা গ্লোবাল কম্পিটিটিভ ইনডেক্সে (জিসিআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে ১০৩ তম। আগেরবার বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০২ তম।

ডব্লিউইএফ বলছে, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ১৬টি সমস্যা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্নীতি। অন্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামো দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ত সুযোগ ও উচ্চ করহার।

প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার যে পাঁচটি দেশ স্থান পেয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম সমস্যা ভারতে। ভারত এবারের প্রতিবেদনে পাঁচ ধাপ এগিয়ে ৫৮ তম স্থানে আছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা চার ধাপ পিছিয়ে ৮৫ তম অবস্থানে আছে। এ ছাড়া এক ধাপ করে পিছিয়ে পাকিস্তান ও নেপাল আছে যথাক্রমে ১০৭ ও ১০৯–এ।

বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ৭৭ তম ও কম্বোডিয়া ১১০ তম স্থানে আছে। আর ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে কম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটি এবার শীর্ষ স্থানে আছে।

মানব উন্নয়ন
মানব উন্নয়নে এক বছরে দুই ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬ তম। গতবার ছিল ১৩৮ তম।

এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ওই দুটি দেশের চেয়ে বেশি। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্কুলে পাঠগ্রহণ—এসব খাতে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে গেছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু গড় আয় বাংলাদেশে অনেক কম।

ইউএনডিপির প্রতিবেদনে, এবার ভারতের অবস্থান ১৩০ তম, আর পাকিস্তানের ১৫০ তম। গতবারের চেয়ে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে গেলেও ভারত ও পাকিস্তান এক ধাপ পিছিয়েছে। মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে ১৮৯টি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গড় আয়সহ বিভিন্ন সূচকে ২০১৭ সালের পরিস্থিতি উঠে এসেছে। সার্বিকভাবে গতবারের মতো এবারও নরওয়ে শীর্ষ স্থান দখল করেছে।

মেধাসম্পদ
গত অক্টোবর মাসে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) যৌথ বার্ষিক সভায় এ সংক্রান্ত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান মান বিবেচনা করলে বাংলাদেশের শিশুরা ভারত ও পাকিস্তানের শিশুদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল হবে। ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬ তম। ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ১১৫ ও ১৩৪ তম। বিশ্বব্যাংক বলেছে, মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ ভালো করেছে। আরও ভালো করার সুযোগ আছে।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার, শিশুদের স্কুলে পাঠ গ্রহণের সময়, শিক্ষার মান, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের অন্তত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা এবং শিশুদের সঠিক আকারে বেড়ে ওঠাসহ বেশ কয়েকটি সূচক দিয়ে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। আদর্শ পরিবেশে শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে শতভাগ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন শিশু বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা পেলে তাঁরা শতভাগ কর্মদক্ষতা দেখাতে পারত, সেখানে তারা অর্ধেকের কম দেখাতে পারবে। ভারত ও পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে আছে। ভারতের শিশুরা ৪৪ শতাংশ ও পাকিস্তানের শিশুরা ৩৯ শতাংশ কর্মদক্ষতা দেখাতে পারবে।

বিশ্বব্যাংকের সূচকে শীর্ষ তিনটি স্থানেই এশিয়ার তিনটি দেশ। প্রথম স্থানে থাকা সিঙ্গাপুরের শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা এমন যে তারা ভবিষ্যতে ৮৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে কোরিয়া ও জাপান।