বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম পড়তি, দেশেও স্বস্তি

চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, পেঁয়াজ—বছরজুড়ে ছয়টি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে তেমন কোনো ওঠানামা ছিল না। দাম ছিল আগের বছরের তুলনায় কম। সব মিলিয়ে মোটাদাগে স্বস্তি নিয়েই বছর পার করতে চলেছে দেশের মানুষ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন সামনে আসছে—দাম যতটা কমা উচিত ছিল, ততটা কি কমেছে? দেশের কৃষকেরা কি ন্যায্য দাম পেয়েছেন?

শুধু ছয় পণ্য নয়, ২০১৮ সালে বিশ্ববাজারে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গুঁড়া দুধ ও মসলার দামও কম ছিল। চাহিদা ও জোগানভিত্তিক কিছু ওঠানামা ছিল। তবে এসব পণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, সেটা বলা যায় না। চাল নিয়ে গত বছর যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা এ বছর কেটে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।

অবশ্য কিছু পণ্য আগের মতোই সাধারণ সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। এর মধ্যে অন্যতম গরুর মাংস, যা এখনো ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে চায়ের দর বেড়েছে। ডিম সময়ে সময়ে নাগালের বাইরে গেছে। কিছু সময় মুরগির দাম ছিল ব্যাপক চড়া, যা এখন কমেছে। সাবান, পেস্ট, ডিটারজেন্টসহ কিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে নভেম্বর শেষে মাসওয়ারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ হার পুরো বছরই ৬ শতাংশের নিচে ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও কিছুটা কম। ডিসেম্বর মাসেও বাজারে পণ্যের দামে তেমন কোনো ওঠানামা নেই। ফলে মূল্যস্ফীতির হার স্বস্তিকর অবস্থায় রেখেই বছর শেষ হবে আশা করা যায়।

জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এ বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মোটামুটি সহনীয় ছিল। এতে ক্রেতারা স্বস্তি পেয়েছেন। তিনি বলেন, পণ্য ও সেবার দাম কতটুকু বেড়েছে, তা নতুন বছরের শুরুতে প্রকাশ করবে ক্যাব।

দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম অস্বস্তিকর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল গত বছর। অবশ্য চলতি বছরের শুরুতে বোরোর ভালো ফলন সেই অস্বস্তি অনেকটাই কমিয়েছে। যদিও চালের দাম আর আগের পর্যায়ে যায়নি। বাজারে এখন সরু চাল ৫৪-৫৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর এই সময় ৬৫ টাকার কাছাকাছি ছিল। ভালো মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৮-৪০ টাকা দরে, যা গত বছর ৫০ টাকায় উঠেছিল। এখন মানুষের ঘরে ঘরে আমন ধানের চাল। কিছুদিন আগে মৌসুম শেষ হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম কম ছিল। ফলে কৃষকেরা আগের মতো দাম পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববাজারে দাম কম
গম, ভোজ্যতেল, চিনি ও ডালের জন্য বাংলাদেশ আমদানির ওপর বেশি নির্ভর করে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ২০১৬ সালে প্রতি টন ৪০০ মার্কিন ডলার ছিল। এখন তা ২৮০ ডলারে। কয়েক বছর ধরেই চিনির দর কম। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকেও পাম তেলের দাম প্রতি টন ৭০৬ ডলার ছিল, যা এখন ৫৪০ ডলারে নেমে এসেছে। একই সময়ে সয়াবিন তেল প্রতি টন ৮৫০ ডলার থেকে ৭২৯ ডলারে নেমেছে। বিশ্ববাজারে গমের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে দেশের বাজারে আটার দামে তেমন কোনো হেরফের হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে দেশের বাজার মেলালে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দর যতটা কমেছে, দেশে ততটা নয়। বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ টাকার মতো কমেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, দেশে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৪-৭ টাকা কমেছে। অন্যদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ১ থেকে ৪ টাকা। বিশ্ববাজারে পাম তেলের দাম কমেছে লিটারে ১৪ টাকার মতো। বিপরীতে দেশে লিটারে কমেছে ৬ থেকে ১০ টাকা।
দেশের বাজারে চিনির দাম কমে প্রতি কেজি ৫০-৫২ টাকায় নেমেছে। বছরের শুরুতে যা ৫৫-৬০ টাকা ছিল। চিনির বাজারে বছরজুড়ে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। ডালের দাম এখন বেশ কম। মোটা মসুর ডাল ৫০-৬০ টাকা কেজিতে মিলছে। সরু মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা কেজিতে। অ্যাংকর ডালও ৪০ টাকার কাছাকাছি দরে নেমেছে। বিশ্ববাজারে ডালের দাম বেশ কম।

কাঁচাবাজার
এবার বর্ষায় সবজির দর মানুষকে ভুগিয়েছে বেশি। তখন অধিকাংশ সময় বেশির ভাগ সবজির দাম ৫০ টাকা বা তার বেশি ছিল। শীতে এসে সবজির দর কমে গেছে। বছরজুড়েই সাশ্রয়ী ছিল আলু। যদিও কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন কি না, সবজির বাজারে সেই প্রশ্ন রয়েছে।
বাজারে মূল্যস্তরের সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা পাঙাশ, তেলাপিয়া ও চাষের কই মাছের গড় দামেও তেমন কোনো হেরফের হয়নি। কিন্তু স্বাদে একটু বৈচিত্র্য আনতে গেলেই চড়া দামের মুখে পড়তে হচ্ছে মানুষকে।