স্বস্তির পাশাপাশি আছে অনেক চ্যালেঞ্জ

>

• বড় প্রবৃদ্ধি নিয়ে নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার
• এ সময়ে আবার ভ্যাট আইন চালু করতে হবে
• শেষ করতে হবে বড় দুটি প্রকল্প
• উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কমাতে হবে তীব্র আয়বৈষম্য
• থাকবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ

নতুন বছরে অর্থনীতিতে যেমন স্বস্তির খবর থাকবে, তেমনি কিছুটা চাপও থাকবে। স্বস্তির বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতার অবসান ঘটাতে এ বছরই কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি কারখানা স্থাপনের জন্য প্রস্তুত হবে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে চলতি অর্থবছরেই সার্বিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঘরে পৌঁছাবে।

আবার এ বছরই পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এই দুটি মেগা প্রকল্প শেষ হলে তা অর্থনীতির জন্য বড় অর্জন হবে। তবে আদৌ চলতি বছর প্রকল্প দুটি শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

চলতি বছরে নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় হতে পারে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন। ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে ২০১৭ সালের জুন মাসে আইনটির বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। আগামী জুলাই থেকে নতুন আইনটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। আবার ব্যাংক খাতে এখন ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে আছে। রয়ে গেছে বড় বড় কয়েকটি ব্যাংক কেলেঙ্কারির রেশ। এই খাতে স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম দূর করতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আছে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

এসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ শুরু হলে, তা ভালো খবরই হবে। তবে শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের কাজ শেষ করলেই হবে না। একজন বিনিয়োগকারীর অন্য সুবিধা যেমন ওয়ানস্টপ সার্ভিস, শুল্ক আইন, কোম্পানি আইন, দক্ষতা উন্নয়ন আইনসহ ব্যবসা সহজীকরণের সংস্কার উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক খাতের অনিয়মের পেছনে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা—দুজনই দায়ী; দোষীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে। এসব করতে পারলে সব মিলিয়ে আমরা একটি রূপান্তরমূলক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাব।’

সম্ভাবনা
বেসরকারি বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরেই জিডিপির অনুপাতে ২১-২২ শতাংশের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটাতে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো খবর হলো, এ বছরই অন্তত চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওই চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, চট্টগ্রামের আনোয়ারার চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও খুলনা অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা নির্মাণের জন্য কয়েক শ শিল্প প্লট প্রস্তুত হয়ে যাবে। এতে বিনিয়োগ যেমন বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থানও হবে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। যদিও লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত কয়েক মাসে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেছেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অন্তত সোয়া ৮ শতাংশ হবে।

স্বাধীনতার পর এটিই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। এর আগে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ১২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এর আগের বছর প্রবৃদ্ধি খুব কম হওয়ায় ওই বছর (১৯৭৪-৭৫) প্রবৃদ্ধি এমনভাবে বেড়েছে।

অন্যদিকে নতুন বছর একটি স্বস্তিদায়ক মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি বনাম বৈষম্য
প্রখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সম্প্রতি ২০১৯ সালের বিশ্ব প্রবৃদ্ধির একটি পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরে শীর্ষ প্রবৃদ্ধির পাঁচটি দেশের একটা হবে বাংলাদেশ। এ বছর সবচেয়ে ভালো করবে সিরিয়া। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ, প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকবে ভুটান, এরপরের স্থানে ভারত, প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। শীর্ষ পাঁচের শেষ দেশটি রুয়ান্ডা, ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

এর আগে গত অক্টোবরে বহুজাতিক ব্যাংক দ্য হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি) ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়ে ৭৫টি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির বিবেচনায় বিশ্বের ২৬ তম বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২ তম। বাংলাদেশের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও পাকিস্তানের মতো দেশ।

তবে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এ নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তাও আছে। বৈষম্য বেড়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) গত নভেম্বর মাসে গবেষণা করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশ উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও এখনো প্রতি চারজনের একজন অতিদরিদ্র আর প্রতি আটজনের একজন দারিদ্র্যের নিম্নসীমার নিচে রয়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও অসমতা বা বৈষম্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সেসব দেশকে উন্নয়ন তত্ত্বে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়, বাংলাদেশ এখন এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সুতরাং আয়বৈষম্য কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন সবাই।

আশা ও অনিশ্চয়তা
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে অগ্রাধিকারভিত্তিতে মেগা প্রকল্প নিতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। এই তালিকায় আছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা–খুলনা রেলপথ নির্মাণ অন্যতম।

আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু ও রাজধানীর মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। প্রকল্প প্রস্তাবেও সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত। গত নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের ৬১ শতাংশ কাজ শেষ। আগামী ডিসেম্বর মাসে পদ্মা সেতু শেষ হলে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তবে শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ করা নিয়ে সংশয় আছে।

২০০৭ সালে একনেক এই প্রকল্পে প্রথম ব্যয় ধরেছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর এখন তা প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সময় বাড়লে খরচও বেড়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে রাজধানীর নাগরিকেরা প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এতে যানজটে নাকাল হওয়ার হাত থেকে রাজধানীবাসীর কিছুটা মুক্তি মিলবে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ২০ শতাংশের মতো হলেও বাস্তবায়ন অগ্রগতি অনেক বেশি বলে জানা গেছে।

চ্যালেঞ্জ অনেক
ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যে ভ্যাট আইন চালু করতে হবে। আগামী জুলাই মাসে এই আইন চালু করার ঘোষণা আছে। ২০১২ সালের এই আইন প্রথম পাঁচ বছর শুধু প্রস্তুতির জন্য রাখা হয়েছিল। এই সময় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে ভ্যাট আইন নিয়ে আলোচনা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) ভ্যাটের যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনে করার প্রস্তুতি নিয়েছে। নতুন আইনে ভ্যাট হার একটি, তা হলো ১৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা চেয়েছিলেন একাধিক ভ্যাট হার। কিন্তু ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এই ভ্যাট আইন চালুর ঠিক আগে ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে সরকার পিছু হটে। আইনটি দুই বছর পিছিয়ে দিয়ে আগামী জুলাই মাসে নতুন সময় ঠিক করা হয়।

অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছে ব্যাংক খাত। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার মতো রিজার্ভ চুরি। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে এই খাতে হল–মার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। অনিয়ম করে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একই পরিবারের হাতে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে ব্যাংক আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। ব্যাংক খাত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এখন নতুন সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনের কারণে নতুন সরকারের দায়িত্ব আরও বেড়েছে। তিনি চান, ব্যবসা সহজ করা, সময়ের কাজ সময়েই শেষ না করলে জবাবদিহি নিশ্চিত করা, হয়রানিমুক্ত কর ব্যবস্থা, বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া, ব্যাংকঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা।