কারও শাস্তি হয়নি, অর্থও ফেরেনি

>
  • এখনো উদ্ধার হয়নি রিজার্ভ চুরির ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার
  • বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৫৫৭ কোটি টাকা
  • ব্যবস্থা নিল ফিলিপাইন, ব্যাংক কর্মকর্তার কারাদণ্ড

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় এখন পর্যন্ত এ দেশের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় সরকার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করলেও তা–ও প্রকাশ করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ নিয়ে দফায় দফায় তদন্ত করেই যাচ্ছে। কিন্তু অর্থ আর উদ্ধার হয়নি।

বাংলাদেশে কিছু না হলেও ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েই যাচ্ছে। চাকরিচ্যুত করা, সিনেটে প্রকাশ্য শুনানি, মামলা এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডের পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়েছে।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত আসে। আর ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখনো উদ্ধার করা যায়নি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৫৫৭ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার তিন বছর পূর্ণ হবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি।

আর এ ঘটনায় মামলা দায়েরের জন্য আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। ওই দলে রয়েছেন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসানসহ ইউনিটের তিন কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি এসব আলোচনায় ভিডিও মাধ্যমে যোগ দিচ্ছেন।

এ ঘটনার তিন বছর পূর্তির আগেই মামলা করতে চায় বাংলাদেশ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোনো ঘটনার তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। এর পাশাপাশি প্রতিনিধিদলটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক ও সোসাইটি ফর ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের (সুইফট) সঙ্গেও আলোচনা করবে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আবু হেনা রাজী হাসান গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ফেব্রুয়ারির মধ্যে মামলা করতে হবে। আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। শিগগির জানা যাবে, কবে মামলা দায়ের হবে। আর কারা আমাদের জন্য আইনি সহায়তা দেবে।’

সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রতিষ্ঠান সেবার জন্য চুরি হওয়া অর্থের ১০ শতাংশ হারে মাশুল চেয়েছে। দেশটিতে অর্থ উদ্ধারে এমন মাশুল আদায়ের প্রবণতা আছে।

মায়া দেগুইতো
মায়া দেগুইতো

এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফিলিপাইনের বিচারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের কী অবস্থা। আমরা মামলা না করলেও তারা নিজেই এ ঘটনার বিচার করছে। তদন্ত হলেও কারও শাস্তি হয়নি। মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও সাবেক অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের আমলে তা হয়নি। এভাবেই তিনি মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দুর্বলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।’

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় পরের মাসে। এ ঘটনায় পদত্যাগ করতে হয় তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে। দুই ডেপুটি গভর্নরকেও সরিয়ে দেয় সরকার। ঘটনা তদন্তে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে কমিটি করে সরকার। বারবার আশ্বাস দিলেও সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

এদিকে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি বারবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে। সর্বশেষ আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য গত বুধবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন ঢাকার একটি আদালত।

এসব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। তাঁরা ফিরে এলেই সিদ্ধান্ত হবে। আর বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে, সরকারও তদন্ত করেছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয় না।’

আরসিবিসির সেই কর্মকর্তার জেল
ম্যানিলা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি ও রয়টার্স জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মানি লন্ডারিংয়ের আটটি অপরাধে মায়া দেগুইতোকে সাজা দেওয়া হয়। প্রতিটি অপরাধের জন্য আইনে চার থেকে সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সব অপরাধের দণ্ড হিসাব করলে দেগুইতোকে ৩২ থেকে ৫৬ বছর কারাভোগ করতে হবে। এ ছাড়া তাঁকে ১০ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়েছে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়ে তা ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় আরসিবিসির একটি শাখায় পাঠানো হয়। এরপর খুব দ্রুত এই অর্থের বড় অংশ দেশটির ক্যাসিনোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আরসিবিসির যে শাখায় অর্থগুলো পাঠানো হয়েছিল, সে সময় তার ব্যবস্থাপক ছিলেন মায়া দেগুইতো। এ ছাড়া ওই শাখার সাবেক এক কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক পাঁচ কর্মীর বিরুদ্ধেও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গতকাল দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দেগুইতোর আইনজীবী। আদালত রায়ে বলেছেন, সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি জামিনে থাকতে পারবেন।

এই মামলায় দেগুইতোই একমাত্র অভিযুক্ত উল্লেখ করে তাঁর আইনজীবী দিমিত্রিও কাস্টোডিও বলেন, তাঁর মক্কেলকে আসলে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। তিনি একা এই কাজ করতে পারতেন না। আরসিবিসি ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান একজন কর্মকর্তাকে এমন পরিকল্পনা আঁটার সুযোগ দেবে না। কাজেই এর সঙ্গে আরও ব্যক্তি জড়িত। আইনজীবী দাবি করেন, তাঁর মক্কেল জরিমানার অর্থ দিতে বাধ্য নন। কেননা, চুরির অর্থ তাঁর নিজের হিসাবে জমা হয়নি।
এক বিবৃতিতে আরসিবিসি বলেছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি ‘ভুক্তভোগী’ মাত্র এবং দেগুইতো একজন ‘বিপথগামী’ কর্মী ছিলেন।
ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়াম সাংবাদিকদের বলেছেন, অর্থ চুরির এ ঘটনায় আরসিবিসির অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে তিনি আশা করছেন।

ফিলিপাইনের বিচার বিভাগ বলেছেন, দেগুইতোকে দণ্ডিত করার মধ্য দিয়েই এই মামলা শেষ হয়ে যাবে না। তবে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় চলমান অন্য মামলাগুলোর ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাটি।

বিশ্বের অন্যতম বড় সাইবার অপরাধের এ ঘটনার পর ফিলিপাইনের অন্ধকার একটি দিক সবার সামনে চলে আসে। দেশটি অনেক দিন ধরেই কালোটাকার স্বর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফিলিপাইনে ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর গোপনীয়তা রক্ষায় কঠোর আইন রয়েছে। এই আইনেরই সুযোগ নিয়েছে হ্যাকাররা। এ ছাড়া ফিলিপাইনের ক্যাসিনো শিল্প তখন দেশটির অর্থ পাচার রোধের আইনের আওতার বাইরে ছিল।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় উত্তর কোরিয়ার একজন হ্যাকারকে খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি ও রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট একটি হ্যাকার গোষ্ঠী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি করেছে বলে দেশটির অভিযোগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনায় মতিঝিল থানায় হওয়া মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। দূতাবাস ও সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে সাতটি দেশের নাগরিকদের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই সব চিঠির কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এ কারণে মামলা ঝুলে আছে। সিআইডি অভিযোগপত্রও জমা দিতে পারছে না।