কাজ, দক্ষ কর্মী দুটোরই অভাব

>

• ১৫ বছরে প্রতিবছর গড়ে ৯ লাখ ৬৬ হাজার নতুন কর্মসংস্থান
• দেশে এখনো প্রায় ১ কোটি লোক বেকার বা ছদ্মবেকার
• প্রতিবছর ২০-২২ লাখ মানুষ কাজের বাজারে আসছেন
• চাকরিদাতা আর কর্মীদের চাহিদার সমন্বয় ঘটছে না

আগামী পাঁচ বছরে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নতুন সরকার। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ৩০ লাখ লোককে কাজ দিতে হবে। সরকার দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে বেকারত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৫ বছরে ১ কোটি ৪৫ লাখ লোক কাজ পেয়েছেন। এখনো প্রায় ১ কোটি লোক বেকার বা ছদ্মবেকার। তার ওপর প্রতিবছর ২০-২২ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে শ্রমবাজারে ঢুকছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ চারটি শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। ২০০২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এই জরিপগুলো করা হয়েছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ওই ১৫ বছরে প্রতিবছর গড়ে ৯ লাখ ৬৬ হাজার নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সময়কালে এটা বছরে গড়ে পৌনে ৭ লাখে নেমে গিয়েছিল।

সুতরাং সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে এখনকার চেয়ে চার গুণের বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদেরা সে ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন। এগুলো হলো শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত কাজ সৃষ্টি করা, সেই কাজের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি করা এবং বাজারমুখী শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো।

দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পগোষ্ঠী এ কে খান গ্রুপের পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন কোন খাতে কোন ধরনের কত লোক প্রয়োজন—এ নিয়ে কেউ কখনো সমীক্ষা করেনি। আমি মনে করি, সারা দেশের ১ হাজার কোম্পানির আগামী পাঁচ বছরে কী ধরনের কত লোক লাগবে, তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করা উচিত। দক্ষ লোকের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জনবল তৈরি করতে পারবে।’

বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সারা দেশে ৬ কোটি ৩৫ লাখ কর্মক্ষম (১৫–৬৫ বছর বয়সী) মানুষ ছিলেন। তবে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী কিছু মানুষও কাজে নিযুক্ত থাকেন। কর্মক্ষম মানুষদের হিসাবে তাঁদেরও ধরা হয়।

২০১৭ সালে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষের কাজ ছিল। বাকি ২৭ লাখ ছিলেন বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মাপকাঠি অনুসারে বেকার তাঁরাই, যাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টাও মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন না। আবার বিবিএস বলছে, কেউ সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে তাঁর সম্ভাবনা পুরোপুরি ব্যবহৃত হয় না। এমন কর্মজীবীদের ছদ্মবেকার বলা যায়। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬৬ লাখ।

ছদ্মবেকারদের দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। তাঁরা পছন্দমতো কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বড় দোকানের খুচরা বিক্রয়কর্মী, কল সেন্টারে কর্মীসহ বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন কাজ করছেন।

২০১৭ সালে বেকার ও ছদ্মবেকার মিলে ভালো কাজের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন প্রায় ৯৩ লাখ মানুষ। গত বছর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়েছে। কর্মসংস্থানের প্রবণতা আমলে নিলে সরকারকে এখনই অন্তত ১ কোটি মানুষের জন্য সপ্তাহে কমপক্ষে ৪০ ঘণ্টার কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জোর দিচ্ছেন তিনটি বিষয়ের ওপর। এগুলো হলো শিক্ষিত তরুণদের উপযোগী শোভন কাজের সুযোগ সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আয় বাড়ানো এবং চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করা।

প্রবাসেও প্রতিবছর বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। গত বছর ১০ লাখ লোক বিদেশে কাজ করতে গেছেন। এর আগের বছর গিয়েছিলেন সাড়ে ৭ লাখ। কিন্তু প্রতিবছর কত লোক ফিরে আসেন, সরকারে কাছে সেই তথ্য নেই। বিদেশে প্রকৃত কর্মসংস্থানের হিসাব তাই করা কঠিন।

বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ জাহিদ হোসেন বলছেন, ‘অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। শিল্প ও সেবা খাতের মতো দক্ষ শ্রমনির্ভর খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এতে উচ্চশিক্ষিত ও মধ্যম শিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থান হবে।’

২০২০ সাল থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সরকার। এই পরিকল্পনা তৈরি করছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। জিইডির সদস্য শামসুল আলম বলছেন, বাড়তি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাজারমুখী শিক্ষা, বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়বে।

শামসুল আলমও বিনিয়োগ বাড়ানোকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন। তিনি অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন।

আওয়ামী লীগের ইশতেহার
গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তরুণদের প্রাধান্য দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের মধ্যে দেড় কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। ওই সময়ের মধ্যে নতুন করে প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রমশক্তিতে যুক্ত হবে।

নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের তথ্যসংবলিত একটি সমন্বিত তথ্য-উপাত্ত ভান্ডার তৈরি করা হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজন এবং তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির জন্য আবেদনের আহ্বান জানাতে পারবে। এ ছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দুটি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।

‘কর্মঠ প্রকল্প’-এর অধীনে স্বল্পশিক্ষিত, স্বল্প দক্ষ, অদক্ষ তরুণদের শ্রমঘন, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উপযোগী জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ‘সুদক্ষ প্রকল্প’-এর অধীনে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা দূর করা হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে প্রায় ১ কোটি লোক চাকরি পাবেন। চলতি বছরে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ওই চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল, চট্টগ্রামের আনোয়ারার চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও খুলনা অর্থনৈতিক অঞ্চল।

এ ছাড়া দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে প্রায় সব জেলায় কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। এখন উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশে বিদেশে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে।

শোভন কাজের জন্য দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে তিন কিস্তিতে ৭৫ কোটি ডলার বা ৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বাজেট সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ইতিমধ্যে প্রথম কিস্তির জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে একটি সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া নেওয়া হবে।

ছদ্মবেকার ও মনমতো কাজ
তবে ছদ্মবেকারদের চিত্র বলছে, পছন্দসই মানসম্মত কাজ এবং যথোপযুক্ত দক্ষ কর্মীদের সমন্বয় ঘটানোর কাজটি সহজ হবে না। জীবিকার তাগিদে এখন যে প্রায় ৬৬ লাখ কর্মক্ষম মানুষ খণ্ডকালীন কাজ করছেন, তাঁরা ভালো কাজের প্রত্যাশী। ছদ্মবেকারদের মধ্যে নারীরা সংখ্যায় বেশি, সাড়ে ৩৪ লাখ।

নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রতি তিনজনে দুজনই কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস। ৬ লাখ ৬৫ হাজার ছদ্মবেকার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও পছন্দমতো চাকরি পাচ্ছেন না। আবার মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ছদ্মবেকার, এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা সাড়ে ৩৭ লাখ। এই শিক্ষিত ছদ্মবেকারেরা খণ্ডকালীন কাজ করে ভালো চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা অপেক্ষা করছেন।

অন্যদিকে চাকরিদাতারা উপযুক্ত কর্মীর আকালের কথা বলছেন। শিল্প উদ্যোক্তা আবুল কাশেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই আমরা চাহিদা অনুযায়ী লোক পাচ্ছি না। বিশেষ করে মধ্যম পর্যায়ের কর্মীদের ক্ষেত্রে দক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য ভারত, শ্রীলঙ্কা থেকে লোক আসছে এখানে। অর্থনীতির পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ লোকের ঘাটতি আরও বাড়ছে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ লোকের জোগান দিতে পারছে না।’