যে মেলায় কেনাবেচা হয় কোটি কোটি টাকার মাছ

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ইছামতী নদীতে একসময় বছরজুড়ে পানি থই থই করত। নদীতে চলত পালতোলা নৌকা। নৌকায় চড়ে বাণিজ্যে আসতেন বণিক ও সওদাগরেরা। জেলেরা দল বেঁধে নদীতে ধরতেন মাছ। ইছামতী নদীর বাঁকে পোড়াদহ বটতলায় প্রায় ৪০০ বছর আগে ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার বসে মাছের মেলা। ইছামতী ছাড়াও করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে ধরা পড়া বড় বড় মাছ মেলা থেকে কিনে ফিরতেন বণিক-সওদাগরেরা। সেই ঐতিহ্য এখনো আছে। রানীরপাড়া মাঠে গতকাল বুধবার বসে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা।

এই মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় মাছ। এই মাছ কিনতে দূরদূরান্ত থেকে দলে দলে ক্রেতারা যান। এ ছাড়া মেলায় ছিল ১৫ থেকে ২০ কেজি ওজনের ছয় থেকে সাত হাজার টাকা দামের একেকটি বাহারি ‘মাছ মিষ্টি’। বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলা, সার্কাস, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলাসহ নানা আয়োজন। শিশুরা কিনেছে খেলনা। মেয়েরা কিনেছে কাচের চুড়ি, আলতা, ফিতা, লিপস্টিক আর নেইলপলিশ।

গতকাল মেলায় লাখো দর্শনার্থীর ঢল নামে। কেনাবেচাও ভালো হয়েছে। মেলার চার শতাধিক দোকানে ১০ কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পোড়াদহ মেলা উপলক্ষে বগুড়ার পাইকারি মাছের আড়ত চেলোপাড়া চাষিবাজারে এক দিন আগে থেকেই কেনাবেচা চাঙা হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মণ বড় বড় মাছ কেনাবেচা চলে বিকেল থেকে ভোররাত পর্যন্ত। পাইকারি এই আড়তে দেশের দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা নদীতে ধরাপড়া এবং পুকুরে চাষ করা মাছ বিক্রি করতে যান। এরপর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসব মাছ কিনে ট্রাকে ও ভটভটিতে করে পোড়াদহ মেলায় যান বিক্রির জন্য।

চাষিবাজারের পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী এবং ফেলুরাম দাস অ্যান্ড সন্স আড়তের মালিক রবীন্দ্রনাথ দাস প্রথম আলোকে বলেন, পোড়াদহ মেলা উপলক্ষে গত মঙ্গলবার রাতজুড়ে চাষিবাজারে প্রায় চার কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে। অন্য আড়ত থেকে মেলায় আমদানি হয়েছে আরও ছয় কোটি টাকার মাছ। সব মিলিয়ে এবারের মেলায় ছিল প্রায় ১০ কোটি টাকার মাছ।

ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা বসেছে। মেলায় উঠছে ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড়। পার-রানিপাড়া, গাবতলি, বগুড়া, ১৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সোয়েল রানা
ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা বসেছে। মেলায় উঠছে ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড়। পার-রানিপাড়া, গাবতলি, বগুড়া, ১৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সোয়েল রানা

আয়োজক ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সাতসকাল থেকেই পোড়াদহ মেলায় মাছ কেনার জন্য মানুষের ঢল নামে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ভটভটি, ইজিবাইক, রিজার্ভ বাস, রিকশা-ভ্যান, মোটরসাইকেল ও টমটমে চড়ে দর্শনার্থীরা মেলায় মাছ কিনতে যান। মেলার দোকানগুলোয় ৫ থেকে ৭০ কেজি ওজনের বাঘাইড়, পাঙাশ, চিতল, কাতলা, রুই, সিলভার কার্পসহ বিভিন্ন ধরনের মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।

পোড়াদহ মেলা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্থানসংকুলান না হওয়ায় এবার পোড়াদহ মেলা ইছামতী নদীর তীর থেকে কিছুটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার মেলায় মাছের আমদানি ও দর্শনার্থীর ভিড় বেশি। মেলায় কোটি কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হচ্ছে।

৩২ বছর ধরে পোড়াদহ মেলায় মাছ বিক্রি করতে যান সিরাজগঞ্জ সদরের মাছ ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ। তিনি বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবার বড় মাছের আমদানি ও ক্রেতা দুটোই বেশি। এবার মেলায় বড় বাঘাইড় প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, পুকুরে চাষ করা রুই মাছ প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ১ হাজার, কাতলা মাছ প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ১ হাজার ২০০, কার্প প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে কেনাবেচা হয়েছে।

রবিউল আলম নামের একজন ক্রেতা মেলায় ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে ১৫ কেজি ওজনের একটি কাতল কেনেন। তিনি বলেন, ‘গতবার মেলায় ২৫ হাজার টাকায় একটি বাঘাইড় মাছ কিনেছিলাম। এবার কাতল কিনলাম।’

মেলায় মাছ ছাড়াও ক্রেতাদের আকর্ষণ ছিল বিশাল আকারের ‘মাছ মিষ্টি’ ও ‘বালিশ মিষ্টি’ কেনার প্রতি। এবারের মেলায় ৫ থেকে ১৫ কেজি ওজনের মাছ মিষ্টি ও বালিশ মিষ্টি বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। মিষ্টি ব্যবসায়ী গাবতলী উপজেলার ধোড়া গ্রামের আবদুল খালেক বলেন, এই মেলায় বড় মাছের মতোই ক্রেতাদের কাছে অন্য রকম কদর রয়েছে বড় মাছ মিষ্টির। এবার সর্বোচ্চ ১৫ কেজি ওজনের মাছ মিষ্টি বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়।

মেলায় ঘুরতে আসা বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী প্রমিতা বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মেলায় বিশাল আকৃতির বাঘাইড় মাছ আর মাছ আকৃতির বড় বড় মিষ্টি পাওয়া যায় বলে তিনি এত দিন শুনেছি। সেটা দেখতেই মেলায় এসেছি। মেলায় বড় মাছ আর বিশাল বিশাল মিষ্টি দেখে আমি অভিভূত।’