দেশেই তৈরি হচ্ছে বয়লার

বয়লার
বয়লার

বড়, মাঝারি ও ছোট প্রায় সব কারখানাতেই বয়লার থাকা আবশ্যক। তৈরি পোশাক কারখানায় যেমন বয়লার রয়েছে, রয়েছে চিনি ও সার কারখানায়ও। এ ছাড়া পাঁচ ও তিন তারকা হোটেল, পোলট্রি, ফিডমিল, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং এবং অটো রাইস মিলে বয়লার থাকতেই হয়। একটি ইঞ্জিনের যে অংশে পানিকে উত্তপ্ত করে বাষ্প তৈরি করা হয়, তার নাম বয়লার।
বয়লারের নিবন্ধন দেওয়ার জন্য সরকারের একটি সংস্থা রয়েছে। সংস্থাটি গুণ-মান যাচাইয়ের জন্য বয়লার পরিদর্শনও করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত এই সংস্থাটির নাম ‘প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়’। কিন্তু ব্রিটিশ আমলের আইন ও পাকিস্তান আমলের বিধির মাধ্যমে চলছে এই সংস্থা। আইন সংশোধনের প্রয়োজনই বোধ করছে না শিল্প মন্ত্রণালয়।
হালকা প্রকৌশল খাতের এই বয়লার একসময় পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর হলেও এখন বেশির ভাগ বয়লার তৈরি হচ্ছে দেশেই। বাংলাদেশ বরং বয়লার রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশি বয়লার গুণ-মানে যথেষ্ট ভালো। তবে বিদেশ থেকে বয়লার আমদানিও বহাল রয়েছে দেশে। সঠিক নীতিমালা না থাকায় এবং বয়লার তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বেশি থাকায় দেশীয় কারখানাগুলো মার খাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রধান বয়লার পরিদর্শক (শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব) জুলফিকার আলী হায়দারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের দিক বিবেচনায় দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়াই আমাদের কাজ। কিন্তু, সবার আগে বয়লার কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই তাঁদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে।’
বয়লারের বাজারটি কত বড়, কত লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে এতে, কত বড় বাজার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে—এ বিষয়ে ব্যবসায়ী কিংবা সরকার কারও কাছেই কোনো তথ্য জানা নেই। তবে দেশের অন্যতম বয়লার উৎপাদক মডার্ন ইরেকশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল গণি ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০০ কোটি টাকার বাজার এবং প্রত্যক্ষভাবে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে এতে।
পোশাক কারখানায় দেশীয় বয়লার: জানা গেছে, তৈরি পোশাক খাতই হলো দেশীয় বয়লারের প্রধান গ্রাহক। ৭০ শতাংশ পোশাক কারখানাই দেশীয় বয়লার ব্যবহার করে। তবে আমদানিকৃত বা দেশীয়—উভয় ধরনের বয়লারেরই নিবন্ধন নিতে হয় প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে।
প্রতিটি বয়লারে একটি নম্বর দেওয়া হয়—বিশ্বজুড়েই এই চর্চা। কিন্তু দেশে কয়টি বয়লার তৈরির কারখানা রয়েছে এবং সে কারখানাগুলোতে বছরে কয়টি বয়লার তৈরি হচ্ছে, তার প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের কাছে।
প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়সূত্র জানায়, ১০-১২টি বয়লার উৎপাদনকারী কোম্পানি বা কারখানা বছরে ২৫০-৩০০টি বয়লার তৈরি করছে। বার্ষিক চাহিদা ৩৫০-৪০০টি বয়লারের। এর মধ্যে ১০০-১৫০টি বয়লার যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, চীন থেকে আমদানি হচ্ছে। দেশীয় বয়লার উৎপাদনকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মডার্ন ইরেকশন, নিউ জি বয়লার, আজাদ বয়লার, ইউনিভার্সেল টেকনোলজিস সার্ভিসেস, গোল্ডেন বয়লার, এসএম বয়লার এবং থার্মোটেক লিমিটেড।
বেসরকারি সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) সম্প্রতি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছে, দেশে বয়লার তৈরির কারখানা রয়েছে ২০০টি। অনেকে উৎপাদন চালু রাখতে পারছে না। কারণ, বয়লারের নিবন্ধন ও নবায়নের প্রক্রিয়া জটিল। অনেকে টিকতে না পেরে বন্ধ করে দিচ্ছেন কারখানা। কেউ কেউ অবৈধভাবেও বয়লার তৈরি করছেন।
জুলফিকার আলী হায়দারী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়টি কারখানা বয়লার তৈরি করছে তা বলা খুবই মুশকিল। কারণ, অনেকেই নিবন্ধন না নিয়ে বয়লার তৈরি করছে।’
উপপ্রধান পরিদর্শক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান অবশ্য জানান, ‘১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০টি বয়লারের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।’
৯০ বছরের পুরোনো আইন: জানা গেছে, পুরোনো আইন দিয়ে চালানো হচ্ছে বয়লার খাত। ১৯২৩ সালের বয়লার আইনের পর ১৯৫১ সালে করা হয়েছিল বয়লার বিধি। এরপর ১৯৫৩ সালের বয়লার অ্যাটেনডেন্টস আইন এবং ১৯৬১ সালের বয়লার অ্যাটেনডেন্টস বিধি অনুযায়ী চলছে এই খাত।
প্রধান বয়লার পরিদর্শক জুলফিকার আলী হায়দারী মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজ সেরে বেলা দুইটায় প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ে যান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
জানা গেছে, দেশে তিন হাজারের মতো অটো রাইস মিল বা স্বয়ংক্রিয় চালকল রয়েছে। এগুলোতে যে বয়লার ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এখনো বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের নিবন্ধনের বাইরে।
প্রধান বয়লার পরিদর্শক জানান, গত ছয় মাসে নীলফামারী ও চুয়াডাঙ্গায় দুইটি বয়লার বিস্ফোরিত হয়েছে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। নীলফামারীর বয়লারটির নিবন্ধন ছিল না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বয়লার যাঁরা চালান, তাঁদের অ্যাটেনডেন্ট বা পরিচালক বলা হয়। আইনে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও বাধ্যতামূলক নয়। তবে, বুয়েটের সহযোগিতায় প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয় প্রতিবছরই একটি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। তাতে বছরে ৭০০-৮০০ জন পরিচালক এ সনদ নেন।
আইন সংশোধন না করলে চালকলের বয়লারগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যাবে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
উল্লেখ্য, বিদেশ থেকে বয়লার আমদানির জন্য আগে প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হতো। বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েই তা আমদানি করা যায়।
সারা দেশে পরিদর্শক মাত্র পাঁচজন: প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের জনবল ৩১। দীর্ঘবছর চারজন থাকলেও সম্প্রতি একজনকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে হয়েছে পাঁচজন পরিদর্শক। এক বছর আগে নতুন করে ছয়জন পরিদর্শক নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়। গুরুত্ব বিবেচনায় ওই মন্ত্রণালয় ছয়জনের ব্যাপারেই সম্মতি দেয়। তবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ অনুমোদন দেয় মাত্র দুজনকে। তা থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) নন-ক্যাডার এই পদে নিয়োগ দেয় একজনকে।
রাজধানীর মিরপুর ও যাত্রাবাড়ী অঞ্চলে অবৈধ বয়লার তৈরির কারখানা রয়েছে বলে বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়ের কাছে ধরা পড়েছে। আইন অনুযায়ী এদের কয়েকটিকে ১০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়ার কথা। সরকারের পক্ষ থেকে তা করা হয়নি।
এত দিন আমদানি করা হলেও বাংলাদেশ এখন বয়লার রপ্তানি করতেও সক্ষম বলে মনে করেন মডার্ন ইরেকশনের চেয়ারম্যান আবদুল গণি। পরিদর্শক বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দেশেই বয়লার তৈরি হওয়ায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। তবে সময় এসেছে এখন এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের। এ ক্ষেত্রে আফ্রিকা একটি সম্ভাব্য বাজার। প্রতিবেশী নেপাল ও ভারতের বাজারও ধরার সুযোগ আছে বলে তিনি আশা করেন।
দেশের ৩০ শতাংশ পোশাক কারখানায় অননুমোদিত বয়লার ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন গোল্ডেন বয়লারের চেয়ারম্যান জাহিদ হাসান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পরিদর্শনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই এই ঘটনা ঘটছে। যে কারণে প্রকৃত উৎপাদকেরা মার খাচ্ছেন আর লাভবান হচ্ছেন একশ্রেণীর পোশাক কারখানার মালিক ও অসাধু বয়লার উৎপাদনকারীরা।