চায়ের বাগানে অভাব দূর

নিজের চায়ের খেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত কমলা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো
নিজের চায়ের খেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত কমলা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো

চা চাষ ধনীদের ব্যাপার—এমন ধারণাই ছিল রফিকুল ইসলাম মোল্লার। ভিটেমাটিসহ রফিকুলদের তিন ভাইয়ের এক একর আবাদি জমি। সেখানে ফলন হয় নামমাত্র। ২০১৩ সালের শেষ দিকে চা চাষের প্রস্তাব এল তাঁদের কাছে। চাষের জন্য প্রশিক্ষণ, চায়ের চারা এবং কিছু অর্থ দিয়েও সহযোগিতা করতে চাইল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের সহযোগিতা নিয়ে তিন ভাই মিলে ২০ শতক জমিতে চায়ের চাষ শুরু করলেন।

উত্তরের শেষ প্রান্তের জেলা পঞ্চগড়ের জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামে রফিকুলের বাড়ি। চাষ করতে গিয়ে তাঁদের মতো ক্ষুদ্র চাষিরা সমিতিও করেছেন। মাঝিপাড়া গ্রামের সমিতির সভাপতি রফিকুল বলেন, ‘শুরুর সময় কত ভাবনা ছিল। চাষ তো করছি, বিক্রি করব কোথায়? এখন আমার এই ২০ শতক জমিতে প্রতি ৪০ দিন পরপর ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার কাঁচা চা–পাতা বিক্রি করি।’

বাড়ির পাশে যেমন বাগান থাকে, তেমন ছোট পরিসরেই চলছে চা চাষ। ট্রেইডক্রাফট নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইকুয়ালিটি নামের প্রকল্পের মাধ্যমে পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলা ও তেঁতুলিয়া এবং ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় চা চাষ শুরু করে। রফিকুলের মতো প্রায় চার হাজার কৃষক এ চাষে জড়িত হন। এখন বাড়ির পাশের অনুর্বর জমিতে সোনা ফলার গল্প তাঁদের মুখে মুখে।

ইকুয়ালিটি টি প্রকল্পের সমন্বয়কারী শাহ সুফি মো. আল মোতোয়াক্কেল বিল্লাহ্ বলেন, চা চাষের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জীবনমান উন্নয়নই ছিল এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।

গত বছরের শেষ দিকে ট্রেইডক্রাফট একটি বেসরকারি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কাইজেন সিএসআরকে দিয়ে চা চাষ প্রকল্পের মূল্যায়ন করায়। দেড় হাজার ক্ষুদ্র চাষির ওপর এই জরিপ চলে। দেখা গেছে, চায়ের উৎপাদনই শুধু নয়, এসব পরিবারের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপকভাবে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সেই পরিবারগুলোকে বেছে নেওয়া হয়, যারা ২০১৫ সাল থেকে এই চাষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

দেখা গেছে, এক বিঘা জমিতে ১ হাজার ৪০০ কেজি চা উৎপাদন করেছেন অন্তত ৭০ শতাংশ কৃষক। এই প্রকল্পে যা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে এই উৎপাদন ১৩ শতাংশ বেশি। নারীপ্রধান পরিবার আবার এ ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে। নারীপ্রধান ৯৫ শতাংশ পরিবার ১ হাজার ৪০০ কেজি চা পেয়েছে। আর ৮১ শতাংশ পুরুষপ্রধান পরিবার এই পরিমাণ চা উৎপাদন করেছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদনের এই হার খুবই ভালো।

নিজের চা–বাগানে কাজ করছেন এক চাষি। ছবি: প্রথম আলো
নিজের চা–বাগানে কাজ করছেন এক চাষি। ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চগড় সদর উপজেলার সোনারবান ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির সদস্য কমলা খাতুন দেড় বছর আগে এই প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ পান। এ সময়ে নয়বার পাতা বিক্রি করেছেন তিনি। প্রতিবার পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কাঁচা চা–পাতা বিক্রি হয়েছে। কমলা বলেন, ‘এই জমি যে এত টাকা দেবে, ভাবিনি কখনো। এই টাকায় নতুন দুটা গরু কিনছি। রান্নাঘরের মেঝে পাকা করেছি। আমার ভবিষ্যৎ এখন এই চা–বাগান।’

এলাকায় গিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে এসব কৃষকের কথা হয়। তাঁদের প্রায় সবাই জানান, এসব জমিতে কষ্টেসৃষ্টে বিঘাপ্রতি চার থেকে পাঁচ মণের বেশি ধান তাঁরা পেতেন না। এখন চা চাষে লাভ বেশি। এই চাষ আর ছাড়ছেন না তাঁরা।

কাইজেনের জরিপে দেখা গেছে, এখন এসব ক্ষুদ্র চাষির বার্ষিক গড় আয় হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৮ টাকা। ফসল উৎপাদন করে তাঁরা যা পেতেন, এখন তার দ্বিগুণের বেশি পান—এমন কথা বলেছেন একাধিক কৃষক।

বাংলাদেশ টি বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, দেশে চায়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এখন চাহিদার তুলনায় ভোগের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে দেশে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়। ওই বছর অভ্যন্তরীণ ভোগের পরিমাণ ছিল ৬৭ মিলিয়ন কেজির বেশি। ২০১৭ সালের প্রায় ৭৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হলেও ভোগ হয় প্রায় ৮৬ মিলিয়ন কেজি।

চা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাড়তে থাকা চাহিদা মেটাতে এখন গৃহস্থালি চা চাষে জোর দেওয়াটা সময়ের দাবি। চা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পানি সার্ভিসের প্রধান নাসিম আনোয়ারের কাছে এই তিন উপজেলার চা চাষের অভিজ্ঞতা জানানো হয়। তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষে আমাদের যেতেই হবে। এ বিষয়ে টি বোর্ডও কাজ করছে। তিন উপজেলায় এ অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে।’

ইকুয়ালিটি টি প্রকল্পটি একেবারে বেসরকারি উদ্যোগ। তবে এই উদ্যোগে উৎসাহিত চা–সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারাও। প্রকল্পটি নিয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শামীম আল মামুন বলেন, ‘এখানে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষকদের নিয়ে যে কাজটি হয়েছে, এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।’

ইকুয়ালিটি টি প্রকল্পের মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ বাংলাদেশ’–এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আলাউদ্দীন প্রধান বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করেই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। একে ছড়িয়ে দিতে আরও উদ্যোগ দরকার।

চা বোর্ড দেশের পঞ্চগড়ে চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করে ইতিবাচক ফল পায় ১৯৯৭ সালের দিকে। এরপরই সেখানে বেসরকারি উদ্যোগে চা চাষ সফল হয়। এখন চা বোর্ড পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষের আরেক প্রকল্প চালু করেছে।