কমিশনের পরিবর্তে কমিটি করা হচ্ছে

>

• ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা
• ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে চার গুণ
• টাস্কফোর্সের বদলে হয়েছে কমিটি

ব্যাংক কমিশন বা ব্যাংক খাত সংস্কার কমিশন শেষ পর্যন্ত হচ্ছে না। হচ্ছে না এ বিষয়ে কোনো টাস্কফোর্সও। তার বদলে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ‘খেলাপি ঋণ পর্যালোচনা কমিটি’ শীর্ষক এই কমিটির সদস্য হবে আপাতত পাঁচজন, পরে বাড়তেও পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মচারী থাকবেন। বাকি দুজন থাকবেন রাষ্ট্রমালিকানাধীন দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।

বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে প্রথম বলেছিলেন, ব্যাংক খাতের কার্যক্রম মূল্যায়নে তিনি একটি কমিশন গঠন করতে চান। মুহিতের যুক্তি ছিল, ব্যাংক খাতের উল্লেখযোগ্য প্রসার হয়েছে। এখন প্রয়োজন এই খাতের সঞ্চয়ন, সুষ্ঠু নীতিমালা ও প্রবৃদ্ধির ধারা নির্ধারণ। মুহিতের ভাষায়, ‘ব্যাংক খাতের প্রচলিত কার্যক্রম এবং এ খাতের সার্বিক অবস্থান মূল্যায়ন ও বিবেচনা করার জন্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা আমাদের রয়েছে।’

এরপর থেকে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরসহ প্রতি বাজেট বক্তব্যেই মুহিত ব্যাংক কমিশন গঠনের পক্ষে কথা বলে গেছেন। মন্ত্রিত্ব শেষ হওয়ার আগে এ ব্যাপারে আর মুখ না খুললেও ব্যাংক খাত নিয়ে তিনি অন্তত একটি প্রতিবেদন দিয়ে যাবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। গতকাল বুধবার পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় মুহিতের কোনো প্রতিবেদন পায়নি বলে জানা গেছে।

আবার নতুন অর্থমন্ত্রী হয়ে আ হ ম মুস্তফা কামালও ঘোষণা দেন, ব্যাংক খাত নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের চিন্তা রয়েছে তাঁর। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের উপস্থাপন করা একটি ফাইলে এখন এসে অর্থমন্ত্রী টাস্কফোর্সের পরিবর্তে খেলাপি ঋণ পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেন। এরপরই বিষয়টি এগোয়।

তবে এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কেউই কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটি খেলাপি ঋণ আদায়ের কৌশল নির্ধারণ, খেলাপি ঋণ আর না বাড়ার উপায় অনুসন্ধান এবং বিপুল পরিমাণ ঋণ অবলোপনের কারণ খতিয়ে দেখবে। পরে কমিটি এসব বিষয়ে তাদের মতামত প্রতিবেদন আকারে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাখিল করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ কমিটি গঠনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে কমিটির পরিবর্তে কমিশন গঠন করাই জরুরি বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের জন্য দরকার হচ্ছে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, আমানতকারী, নীতিনির্ধারকসহ সব পক্ষকে নিয়ে অন্ততপক্ষে অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও একটি কমিশন গঠন করা। কারণ, খেলাপি ঋণ পর্যালোচনা কমিটি ব্যাংক খাতের পুরো চিত্র তুলে আনতে পারবে না।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে সাড়ে চার গুণ। এর বাইরে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো অবলোপন করা ঋণের ১১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা আদায়ও করেছে। গত সেপ্টেম্বরের হিসাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ব্যাংকগুলোর দেওয়া গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে, যার পরিমাণ ১৭ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৬০০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ৫ হাজার ৭৫১ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৪ হাজার ১১৬ কোটি, বেসিক ব্যাংকে ৮ হাজার ৬১৮ কোটি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) ৮৩২ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ নিয়ে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের মূল চিন্তা খেলাপি ঋণ কমানো। এটা নিয়ে জাতির উৎকণ্ঠা, আমার নিজেরও উৎকণ্ঠা। তবে এক টাকাও খেলাপি ঋণ আর বাড়তে পারবে না।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা। কিন্তু ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততা, প্রভিশন ঘাটতি, পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন, সুশাসনের ঘাটতি—এসব সমস্যাও রয়েছে। কমিশন গঠিত হলে এগুলোর সমাধানে গভীর এবং ভালো কিছু পরামর্শ পাওয়া যেত।’