বাজার এখন ৬৬ হাজার কোটি টাকার

দেশে ইস্পাত ও সিমেন্টের চাহিদা প্রতিবছর বাড়ছে । মূলত সরকারি প্রকল্প ও আবাসন খাতে ভর করে এই দুটি শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে।  সৌরভ দাশ
দেশে ইস্পাত ও সিমেন্টের চাহিদা প্রতিবছর বাড়ছে । মূলত সরকারি প্রকল্প ও আবাসন খাতে ভর করে এই দুটি শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। সৌরভ দাশ

সরকারি প্রকল্প ও আবাসন খাতে ভর করে প্রতিবছর বাড়ছে ইস্পাত–সিমেন্টের চাহিদা। ২০১৮ সাল শেষে এই দুই খাতের বাজারের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে বাজারের আকার ছিল প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। গত বছর এই দুই খাতের পণ্যের দাম বাড়ায় বাজারের আকারও বছর শেষে বেড়ে গেছে। 

দুই খাতের উদ্যোক্তারা জানান, গত বছর দেশে সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ টন। গত বছর গড়ে টনপ্রতি সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার টাকায়। এ হিসাবে গত বছর সিমেন্টের বাজারের আকার ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে রড, ঢেউটিন, পাইপসহ ইস্পাত পণ্য ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৬৯ লাখ টন। সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দর হিসাব করে টনপ্রতি ইস্পাত পণ্যের গড় দাম পড়ে ৬০ হাজার টাকা। এ হিসাবে রডসহ ইস্পাত পণ্য বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা।
ইস্পাত ও সিমেন্ট খাতের সংগঠন ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে বাজারের আকার সম্পর্কে এই তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানি থেকে প্রস্তুত পণ্য তৈরির হার বিবেচনায় নিয়েও এই হিসাব পর্যালোচনা করা হয়েছে। একই হিসাবে গত বছর সিমেন্টের বাজার ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ইস্পাতের বাজারের আকার ছিল প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।
এই দুই খাতের বাজার নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে ইস্পাত ও সিমেন্ট সবচেয়ে বড় খাত। দুই খাতে বাজারের আকার ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে যে ঘাটতি আছে তা বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকলে এই বাজার আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বাড়বে। কারণ এখন সরকারি খাতে অসংখ্য বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। শুধু টানেল থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগামী দিনে এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে, যেসব প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হবে ইস্পাত ও সিমেন্ট। সরকারি অবকাঠামো শেষ হলে বেসরকারি খাতে শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাপকহারে শুরু হবে। যেমন, পদ্মা সেতু নির্মাণের পর দক্ষিণাঞ্চলে বেসরকারি খাতে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠবে। ফলে নির্মাণের এই দুই খাতে ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি।

সিমেন্টে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ
সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতি ও উদ্যোক্তাদের হিসাবে, নির্মাণ খাতের উপকরণের মধ্যে গত বছর প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে সিমেন্ট খাতে। সমিতি জানায়, ২০১৭ সালে দেশের সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ টন। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ১৩ লাখ টনে। দেশে ৩১টি কোম্পানির ৪০টি প্ল্যান্টে এসব সিমেন্ট উৎপাদন হয়। সিমেন্ট কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টন।
কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সিমেন্টের এই প্রবৃদ্ধি আগামী বছরগুলোতে বাড়বে। এর কারণ হলো এখনো অনেক প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ফলে এখন যেভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে সরকারি খাতের পাশাপাশি গ্রামেও বেসরকারি খাতে অবকাঠামো হচ্ছে। প্রবাসী আয় বাড়ায় স্বচ্ছল পরিবার এখন পাকা ভবন নির্মাণে ঝুঁকছে। আরসিসি রাস্তা নির্মাণের হারও বাড়ছে। আগামী ১৫ বছর পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিডব্লিউ রিসার্চ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সিমেন্ট মার্কেট রিপোর্ট ২০১৭’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি অবকাঠামো উন্নয়নে সিমেন্টের ব্যবহার ৩৫ শতাংশ। ব্যক্তি উদ্যোগে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহার ৪০ শতাংশ। আবাসন খাতে তা ২৫ শতাংশ।
বৈশ্বিক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, গত বছর বাংলাদেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ছিল ১৯০ কেজি। সাধারণত সিমেন্ট খাতে মাথাপিছু ব্যবহার ৬০০ কেজি হলে প্রবৃদ্ধির গতি কমতে থাকে। এই তথ্য বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে এখনো সিমেন্ট খাতে তিন গুণ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
আবার মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে সিমেন্টের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৩৫ থেকে ১ দশমিক ৫৫ গুণ বাড়ে। গত এক দশকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগামী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরে থাকবে। এ হিসাবেও

সিমেন্টের প্রবৃদ্ধি দুই অংকের বেশি হবে।
সিমেন্টের বৈশ্বিক বাজারের আকারও অনেক বড়। গ্লোবাল সিমেন্ট প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বে ৪১২ কোটি ৯০ লাখ টন সিমেন্ট ব্যবহার হয়। ওই বছর সিমেন্ট উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৬১৩ কোটি ৮০ লাখ টন। সিমেন্টের বাজারের আকার ছিল ৩৯৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা।

ইস্পাত খাতের বাজার বাড়ছে
বাংলাদেশে লং স্টিল বা রড, চ্যানেল ও অ্যাঙ্গেল এবং ফ্ল্যাট স্টিল বা ঢেউটিন, পাইপ ও ইস্পাতের পাত—এই দুই ধরনের ইস্পাত পণ্যের বাজার প্রতিবছর বড় হচ্ছে।
সরকারি হিসাবে দেখা যায়, গত বছর সব ধরনের লৌহ ও ইস্পাত পণ্যের প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি হয়েছে প্রায় ৮২ লাখ টন। ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত পণ্য পাওয়া গেছে প্রায় ৬৯ লাখ টন। এর আগের বছর ২০১৭ সালে ইস্পাত পণ্য ব্যবহারের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৮ লাখ টন। এ হিসাবে ইস্পাত খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ। ইস্পাত পণ্যের বড় অংশই হলো রড। এরপরে রয়েছে ঢেউটিন, পাইপসহ ইস্পাতের নানা পণ্য।
ইস্পাত পণ্যের বাজার সম্পর্কে বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলীহোসেইন আকবরআলী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের মেগা প্রকল্পে ইস্পাতের ব্যবহার এখন সবচেয়ে বেশি। মেট্টোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে ও বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় প্রকল্পগুলোতে প্রচুর ইস্পাত পণ্য দরকার হচ্ছে। আগামী ১০ বছর ইস্পাত পণ্যের এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
ইস্পাত পণ্য প্রস্তুতকারক কয়েকটি কোম্পানির জরিপে দেখা গেছে, বছরে ন্যূনতম ১০ হাজার মেট্টিকটন রড উৎপাদন করে এমন কারখানার সংখ্যা ৫২টি। এসব কারখানাই ৯৮ শতাংশ রড উৎপাদন করে। এর বাইরে ফ্ল্যাট স্টিল বা ঢেউটিনসহ পাত উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানা রয়েছে। ইস্পাত খাতে ছোট ও সনাতনী কারখানার সংখ্যাও অনেক।
ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, বিশ্বে ২০১৭ সালে ১৫৮ কোটি ৭০ লাখ টন ইস্পাত পণ্য ব্যবহার হয়। এর ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশই ব্যবহার হয়েছে চীনে। বিশ্বে জনপ্রতি গড় ইস্পাতের ব্যবহার হলো ২০০ কেজি। চীনে জনপ্রতি ব্যবহার ৫২২ কেজি। ভারতে তা ৬৫ দশমিক ২ কেজি। গত বছরের হিসাবে, বাংলাদেশে মাথাপিছু ইস্পাতের ব্যবহার ৪২ কেজি।